পীতম রাগে কাঁপিতে কাঁপিতে বলে, বাইর তুই আমার বাড়ির থেইকা নকুইলা, দূর হ!
নকুল মুচকি হাসিয়া বলে, গোসা কর ক্যান মামা! জবাব দিবার পার না মাইঝা কর্তা কুবিররে এত খাতির করে ক্যান–তাই জিগাইয়া? কুবেরের পোলা কেমন ধলা হইছে জিগাও।
কুবের মুষ্টি তুলিয়া বলে, মারুম কইলাম নকুইলা, মাইরা লাশ করুম তরে।
মনে হয়, সভার চেহারা বদলাইয়া গিয়াছে। রাসু ও হোসেন মিয়াকে উপলক্ষ করিয়া সভায় যে চাপা অসন্তোষ ও প্রতিবাদের ভাব আসিয়াছিল প্রসঙ্গান্তরে এখন তাহা বিলীন হইয়া গিয়াছে। ও বিষয়ে আর কাহারও কিছু বলিবার বা ভাবিবাব নাই। হোসেন মিয়া উঠিয়া দাঁড়ায়!
বিয়ানে একরার বাড়িত যাইও রাসু বাই। পয়সা কড়ি পাইবা মালুম হয়, নিকাশ নিয়া খারিজ দিমু! ময়নাদ্বীপির জমিন না নিলি জঙ্গল কাটনের মজুরি দিই–খাওন পরন বাদ। কাইল যাইও। লালচে দাড়ির ফাঁকে হোসেন মিয়া মৃদু মৃদু হাসে, বলে, মন করতিছ, হোসেন মিয়া ঠক। তোমারে ঠকাইয়া হোসেন মিয়ার ফয়দা কিসির? কোন হালারে আমি জবরদস্তি ময়নাদ্বীপি নিছি? আপনা খুশিতে গেছিলা, ঝুট না কলি মানবা রাসু বাই। ফিরা আইবার মন ছিল, আমারে কতি পারলা না? একসাথে আইতাম?
রাসু ঘাড় নিচু করিয়া থাকে। আমিনুদ্দি বলে, যান নাকি মিয়া?
হ!
শোনেন। আমি ময়নাদ্বীপি যামু না। কইয়া থুইলাম।
হোসেন মিয়া তেমনি মৃদু মৃদু হাসে।
তোমারে যাতি কই নাই আমিনুদ্দি। খুশ না হলি ক্যান যাবা?
পাতলা পাঞ্জাবি ঘামে ভিজিয়া যাওয়ায় হোসেন মিয়ার বুকের নিবিড় লোমরাজি দেখা যাইতেছিল। সেইখানে হাত দিয়া সে আবার বলিল, জান দিয়া তোমাগো দরদ করি, এ্যানে আইজ তোমরা ঘা দিলা, এই দিলের মদ্যি–কুবের বাই, ঘর যাইবা নাকি?
কুবের সায় দিয়া উঠিয়া আসিল। দুজনে গোয়াল পার হইয়া নামিয়া গেল পথে। আকাশ নিবিড় মেঘে ঢাকিযা গিয়াছে, দুর্ভেদ্য অন্ধকারে জেলেপাড়ার পথ পায়ের তলেও হইযা আছে অদৃশ্য। অত্যন্ত সন্তর্পণে পা ফেলিয়া আগাইতে হয, দীর্ঘকালের পবিচয় না থাকিলে বাড়ির আনাচকানাচ দিয়া আঁকাবাঁকা পথ তাহারা খুঁজিয়া পাইত না। কুবেরের বাড়ির কাছাকাছি আসিয়া আকাশের জমানো মেঘ হঠাৎ গলিয়া যাওয়ায় চোখের পলকে তাহারা ভিজিয়া উঠিল। কুবেরের সঙ্গে হোসেন মিয়াও উঠিল গিয়া তাহার ভাঙা কুটিরে।
দাওয়ায় ছাট আসিতেছিল, হোসেন মিযাকে ঘরের মধ্যেই বসিতে দিতে হইল। কুবেরের দুই ছেলে লখা ও চণ্ডী ঘুমাইয়া পডিয়াছিল, জাগিয়া ছিল গোপি। চাটাইয়ের উপব জাঁকিয়া বসিয়া হোসেন মিয়া তাহাকে আদর করিয়া কাছে ডাকিল, বলিল, পিয়াস জানায় বিবিজান, পানি দিবা না? গোপি ঘটিতে জল আনিয়া দিলে আলগোছে মুখে ঢালিয়া দিযা ঘটিটা দাওয়ার প্রান্তদেশে রাখিল। ঘরের চাল বাহিয়া যে জলের ধারা পড়িতেছিল আঁজলা ভরিয়া সেই জল ধরিয়া ঘটির গাযে ঢালিয়া ঢালিয়া ঘটিটি গোপি করিয়া লইল শুদ্ধ।
রাত্রি বাড়িতে থাকে, বৃষ্টি ধরিবার লক্ষণ দেখা যায় না। পিসি টেঁকি ঘরে গিয়া ঝাঁপ বন্ধ করিয়া শুইয়া পড়ে, ভাইদের পাশে শুইয়া গোপির দুচোখ ঘুমে জড়াইয়া আসে, শ্রান্ত কুবেরের চোয়াল ভাঙিয়া হাই উঠে, বাহিরে চলিতে থাকে অবিরাম বর্ষণ। কিছুক্ষণ বৃষ্টি হইবার পর ঘরের ফুটা কোণ দিয়া ভিতরে জল পড়িতে আরম্ভ করিয়াছিল, চাহিয়া দেখিয়া হোসেন মিয়া আপনা হইতে কাল সকালেই কুবেরের ঘর ছাইবার শণ দিবার কথা বলিয়াছে। কুবের একসময় উঠিয়া গিয়া মালার অবস্থা দেখিয়া আসে। বহু যত্নে কুবের তাহার আঁতুড়ের চারিদিকে বেড়ার সমস্ত ফুটা বন্ধ করিয়াছে, দাওয়ার এদিকটা ভাসিয়া গেলেও আঁতুড়ে বৃষ্টির ছাট ঢুকিবার কোনো পথ নাই। মেঝেটাই শুধু হইয়া আছে ভিজা স্যাঁতসেঁতে যার কোনো প্রতিকার করার সাধ্য কুবেরের নাই। আর কটা দিন পরেই মালা এখান হইতে মুক্তি পাইবে। বুকে পিঠে তাহার যে অল্প অল্প ব্যথা হইয়াছে, কদিন এখানে থাকার ফলে সেটা বাড়িয়া না গেলেই বাঁচা যায়।
মালা ভয়ে ভয়ে বলে, আমারে দুগা মুড়ি চিড়া দিবা গো?
ক্যান, ভাত খাস নাই?
খাইছি। ভাতে টান পড়ল, পেট ভইরা খাই নাই। অখন খিদায় পেট জ্বলে।
জ্বালাইয়া মারস্ বাপু তুই। বলিয়া কুবের হাঁড়ি কলসি খুঁজিয়া পিসির নিজের জন্য লুকানো কতকগুলি চিড়া মালাকে আনিয়া দেয়। উঠিয়া বসিয়া অন্ধকারেই চিড়া মুখে দিয়া মালা বলে, হোসেন মিয়ারে খাইতে দিবা না?
কী দিমু?
মেলার থেইকা আম না আনছিলা? তাই দাও—করবা কী! খিদায় মানুষটা খুন হইয়া যায় না।
কুবেরের সহসা মনে পড়িয়া যায়। ভাবে, সিধুর কাছ হইতে যে মাংসের ব্যঞ্জন পাওযা গিয়াছে তাই দিয়া আতিথ্য করিলে মন্দ হয় না। মুসলমান মানুষ, মাংস বেশ পছন্দ করিবে। কিন্তু পরক্ষণেই এ বিষয়ে কুবেরের উৎসাহ কমিয়া যায়। এমন একদিন ছিল হোসেন মিয়া যখন খাসির মাথার ব্যঞ্জন পাইলে ধন্য হইয়া যাইত, আজ যার তার রান্না ও সব কী আর সে খাইবে? শুধু না খাওয়া নয়, খাইতে বলিলে হয়তো সে আজ অপমানই বোধ করিয়া বসিবে। তার চেয়ে আম যখন আছে, তাই দেওয়া ভালো।
ঘরে গিয়ে কুবের একটু অবাক হয়। চাটাইয়ে চিত হইয়া শুইযা ইতিমধ্যেই হোসেন মিযা ঘুমাইয়া পড়িয়াছে। কুবের সন্তর্পণে মৃদুস্বরে একরার বলে, মিয়া বাই? সাড়া না পাইয়া ঠেলা দিয়া ঘুম ভাঙায় গোপির।