কান্নার মধ্যেও পীতম চমকাইয়া উঠিল। একেবারে বেখাপ্পা সুরে প্রশ্ন করিল, কস কি রাসু, সব কটা গেছে?
বাসু সায় দিয়া বলিল, সব গেছে মামা, আমার কেউ নাই।
কেহ নাই। এক স্ত্রী, দুই পুত্র ও এক কন্যা, একুনে এই চারজনকে সঙ্গে লইয়া সে নিরুদেশ যাত্রা করিয়াছিল, হোসেন মিয়ার জঙ্গলাকীর্ণ ময়নাদ্বীপের উপনিবেশে একে একে চারজনেই মৃত্যুর দেশে নিরুদ্দেশ হইয়া গিয়াছে। এই গভীর শোকাবহ সংবাদে কেতুপুবের জেলেপাড়া নিবাসী নরনারী মূক হইয়া গেল। অথচ এই সংবাদ রাসুর আকস্মিক আবির্ভারের মতোও বিস্ময়কর নয। সকলেই ইহা জানিত। সমুদ্রেব মধ্যে যে দ্বীপে সৃষ্টির দিন হইতে মানুষ বাস করে নাই সেখানে গিয়া কাহারও বাঁচিবার উপায় আছে? রাসুরা যখন সেখানে যায় তখনই সকলে নিশ্চিত জানিয়াছিল তাহারা মরিতে যাইতেছে। রাসু যে জীবিতারস্থায় ফিরিয়া আসিয়াছে আশ্চর্য তো এইটুকুই! এমনই আশ্চর্য যে রাসুকে সম্মুখে উপস্থিত দেখিয়াও যেন বিশ্বাস হইতে চাহে না যে সে সত্যসত্যই ফিরিয়া আসিয়াছে।
ধনঞ্জয়ের বউ বুতিব মা একটি কলাই করা পাত্রে খানিকটা ঘোল আনিয়া দেয়, রাসু চোখের পলকে এক নিশ্বাসে তাহা গিলিযা ফেলে। সমবেত জনতা এতক্ষণ বিশৃঙ্খল হইয়াছিল, ক্ৰমে কমে প্রত্যেকে এক একটি সুবিধাজনক স্থান গ্রহণ করিয়া বসিয়া পড়িলে রাসুকে ঘিরিয়া একটি সুন্দর শৃঙ্খলাবদ্ধ সভার সৃষ্টি হয়। তারপর একে একে উঠিতে থাকে প্রশ্ন। জবাবে রাসুর প্রত্যেকটি কথা সকলে সাগ্রহে গিলিতে থাকে।
পীতম শিহরিয়া জিজ্ঞাসা করে, ময়নাদ্বীপে বাঘ সিঙ্গি আছে না রাসু?
আছে না? বাঘ সিঙ্গিতে বোঝাই!
বলিয়া সকলের মৃদু শিহরন লক্ষ করিয়া এই অধমৃত অবস্থাতেও গর্বের উত্তেজনা রাসুকে যেন নবজীবন দান করে, ভাঙিয়া পড়িবার ভঙ্গিতে বসিয়া থাকার বদলে হঠাৎ সে হইয়া যায় সিধা! বলে, বাঘ সিঙ্গি! বাঘ সিঙ্গির নামে ডরাইলা? কী নাই ময়নাদ্বীপে কও? সাপ যা আছে এক একটা, আস্তা মাইন্ষেরে গিলা খায়! রাইতে সুমুন্দুরের কুমির ডাঙ্গায় উঠা আইসা মাইন্ষেরে টাইনা নিয়া যায়—
হ, বলিতে বলিতে মুখ খুলিয়া যায় রাসুর, আর শুনিতে শুনিতে হাঁ হইয়া যায় তাহার শ্রোতাদের মুখগুলি। হোসেন মিয়ার ময়নাদ্বীপ, এমন ভীষণ স্থান সেটা?
যাহারা রথের মেলায় গিয়াছিল একে একে তাহারা ফিরিয়া আসিতে থাকে। সন্ধ্যার সময় জেলেপাড়ার ঘরে ঘরে আজিকার সন্ধ্যাটি নামে সানন্দে। বউরা হাসিমুখে লাল পাছাপাড় শাড়ি নাড়িয়া চড়িয়া দ্যাখে, নুতন কাঁচের চুড়িব বাহারে মুগ্ধ হয়, কাচ ও কাঠের পুঁতির মালা সযত্নে কুলুঙ্গিতে তুলিয়া রাখে, ছেলেমেযেরা বাঁশি বাজায আর মাটির পুতুল বুকে জড়াইয়া ধরে। আহ্লাদ বহন করিয়া এই তুচ্ছ উপকরণও যে কুটিরে আসে না, সেখানে যে বিষাদ জমাট বাঁধিয়া থাকে তা নয়, কোনো না কোনো রূপে সোনাখালির মেলার আনন্দের ঢেউ সে কুটিরেও পৌঁছিয়াছে। একটি কাঁটাল, দুটি আনারস, আধসের বাতাসা—এই দরিদ্রের উপনিবেশেও যে দরিদ্রতম পরিবার শুধু নুন, আর অদৃষ্টকে ফাঁকি দিয়া ধরা পুঁটির তেলে ভাজা পুঁটিমাছ দিয়া দিনের পর দিন আধপেটা ভাত খাইয়া থাকে–খুশি হইয়া উঠিতে আর তাহাদের অধিক প্রয়োজন কীসের? কুবেরের প্রতিবেশী বুড়া সিধু দাস একটি পয়সা সম্বল করিয়া মেলায় গিয়াছিল, পয়সাটি সে খরচ করে নাই কিন্তু মেলা হইতে সে যে বিপুল সম্পদ সংগ্ৰহ করিয়া আনিয়াছে তাহাতে তাহার বৃহৎ পরিবারে আজ উৎসবের অন্ত নাই। ভিক্ষা সিধু করে নাই, বাগাইয়াছে। সাবাদিন মেলায় ঘুবিয়া যেন-তেন-প্রকারেন সংগ্রহ করিয়াছে। সংগ্ৰহ করিয়াছে তিনটি দাগ-ধরা প্রকাণ্ড ফজলি আম, একটা তুলতুলে পাকা আস্ত খাজা কাঁটাল, সের তিনেক একত্র মেশানো চাল ডাল খুদ আর খাসির একটা মাথা। গরিবের উৎসবে আর কী চাই? কুড়ানো ফেলনা জিনিস! খাসির মাথাটা ধরিতে গেলে সে একরকম চুরিই করিয়াছে বলিতে হয়, কিন্তু তাতে কী, ভিক্ষা সিধু কারও কাছে চায় নাই, পয়সা সিধু কারও চুরি করে নাই।
কুবেরেব উঠানে দাঁড়াইয়া সিধু বলে, আমারে না নিয়া ফিরা আলি কুবির?
দাওয়ার ডিবরির আলোতে কুবের একটা কোঁচের লোহার শলাকাগুলি পরীক্ষা করিতেছিল, মুখ না তুলিয়াই বলে, তুমি না হারু জ্যাঠার নায় আগেই ফিরা আইলা?
সিধু দাওয়ায় উঠিয়া যায়।
তা আইলাম কুবিব, তা আইলাম। রঙ্গ করা কইলাম, বোঝস না? কোঁচটা কিনা আনলি সন্দ করি! নিল কত?
আষ্ট আনা।
আট-দশহাত লম্বা সরু তল্লা বাঁশের ডগায় দশ-বাবোটি তীক্ষ লোহার শলাকা বসানো মাছমারা যন্ত্রটি সিধুও গম্ভীর মুখে পরীক্ষা করিয়া দ্যাখে। গোড়ার দিকটা ধরিয়া অন্ধকার উঠানে ছুড়িবার অভিনয় করিযা বলে, ভার মন্দ না, জিতছস কুবির। কাল পরশুতক আমিও একটা কিনা লমু।
সিধুর মতলব কুবের ঠিক বুঝিতে পারে না। কোঁচটি সে ঘরের মধ্যে কোনায় দাঁড় করাইয়া রাখিয়া আসে। বিকালে বৃষ্টি বন্ধ হইয়া গুমোট করিয়া আছে; আকাশে বিশেষ মেঘ নাই বটে কিন্তু কখন যে মেঘ ঘনাইয়া আসিয়া মুষলধারে বৃষ্টি নামিবে বলা যায় না। রাসুকে পীতম তাহার বাড়ি লইয়া গিয়াছে। এখন হয়তো আবার তাকে ঘিরিয়া সভা বসিয়াছে সেখানে, নিজের নির্বাসনের কাহিনি বলিয়া রাসু সকলকে মুগ্ধ করিয়া রাখিয়াছে। অত্যন্ত ক্ষুধা না পাইলে কুবেরও সেখানে গিয়া বসিত।