কিছুক্ষণ পরে একটা জীর্ণ পুরাতন নৌকা আসিয়া ভিড়িল পাশে। দুজন অচেনা মাঝি নৌকা বাহিয়া আসিয়াছে। ভিন গায়ের নৌকা। নৌকার খোলটা কাঁটালে এমন ভাবেই বোঝাই করা হইয়াছে যে নৌকার প্রান্তভাগ জলের উপর কয়েক ইঞ্চিমাত্র ভাসিয়া আছে। উপরে কোনোরকম আবরণ নাই, গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টিতে মাঝি দুজন এবং রাসু তিনজনেই ভিজিয়া গিয়াছে। তাড়া দিয়া রাসুকে এ নৌকায় নামাইয়া দিয়া মাঝি দুজন বোধ হয় তাহাকে গাল দিতে দিতেই তৎক্ষণাৎ আবার ঠেলা দিয়া নৌকার মুখ ফিরাইয়া বইঠা ধরিল। পদ্মানদীর চিরন্তন রীতি অনুসারে কুবের জিজ্ঞাসা করিল, কোন গাঁও থেইকা আইলা মাঝি, যাইবা কোয়ানে?
জবাব দিবার রীতিও চিরন্তন। তাহারা সক্রোধে বলিল, সুলপী থেইক আইলাম, যামু মেলায়।
রাগের কারণটা তাহদের সহজেই বোঝা যায়। সুলপী হইতে সোজাসুজি সোনাখালির মেলায় যাওয়ার বদলে রাসুকে এখানে পৌঁছাইযা দিতে তাহদের পদ্মা পার হইতে হইয়াছিল। প্রতিদানে রাসু যে তাহদের কিছুই দিতে পারে নাই তাহাও অত্যন্ত সুস্পষ্ট। কিন্তু এ ক্ৰোধ তাহাদেব ফলপ্রসূ নয়,— এ শুধু ক্ৰোধ। রাসুর মতো দুরবস্থায় পড়িয়া আবার যখন কেহ তাহদের পদ্মা পার করিয়া দিবাব অনুরোধ জানাইবে এমনি ভাবে রাগিয়া উঠিলেও সেই নিরুপায় মানুষটিকে তাহারা না বলিতে পরিবে না, বিনা প্রত্যাশায় বোঝাই নৌকা লইয়া তিন ক্রোশ অতিরিক্ত বইঠা বাহিরে। ইহা মহত্ত্ব নয়, পরোপকার নয়—ইহা রীতি, অপরিহার্য নিয়ম। আশ্চর্য এই, এ নিয়ম পালন করিয়া ক্রুদ্ধ হইয়া উঠাও অনিয়ম নয়।
নৌকায় পা দিয়া রাসু খানিকক্ষণ আড়ষ্ট হইয়া দাঁড়াইযা রহিল। তারপর কুবেরকে জড়াইয়া ধরিয়া গদগদ কণ্ঠে বলিল, আমি আলাম গো কুবিরদা।
কন থে আলি রাসু?
কই কুবিরদা, কই। তোমাগো দেইখা মুখে রাও সবে না, কতকাল পরে ফিরা আলাম।
কুবেব ও গণেশ তাহার চোখে জল দেখিতে পাইল। ধনঞ্জয় পড়িয়াছিল তাহার পিছনে, সে উপস্থিত থাকিতে রাসু যে আসিয়া পৌঁছিয়াই কুবেবকে জড়াইয়া ধরিয়া আহ্বাদে ডগমগ হইয়া উঠিল ইহাতে মনে মনে সে ঈর্ষাতুর ও অসন্তুষ্ট হইযা উঠিয়াছিল। রাসুর আবির্ভাবে উত্তেজনা তাহারও কম হয় নাই। তাহা গোপন করিয়া শান্ত উদাস ভাবে সে বলিল, বয় রে রাসু, বয়।
কুবেরকে ছাড়িযা রাসু হোগলার নীচে নৌকার আধভেজা পাটাতনের উপর বসিয়া পড়িল। হাতের উলটা পিঠে চোখ মুছিযা পরনের জীর্ণ বসনে ঘসিযা হাতে লাগা অশ্রু পুঁছিয়া ফেলিল। তিন জোড়া চোখ চাহিয়া রহিল তাহার শীর্ণ কঙ্কালসার দেহটির দিকে। তিন বছর আগে হোসেন মিয়ার সঙ্গে সপরিবারে সে যখন ময়নাদ্বীপের উদ্দেশে যাত্রা করিয়াছিল দেহ তখন তাহার অবশ্য বিশেষ পরিপুষ্ট ছিল না, কিন্তু এমন ভাবে ভাঙিয়াও সে পড়ে নাই। রাসুর মাথায় বড়ো বড়ো চুল জট বাঁধিয়া গিয়াছে, সর্বাঙ্গে অনেকগুলি ক্ষতেব চিহ্ন, কযেকটা ঘা এখনও ভালো করিয়া শুকায় নাই। দুটি পা-ই তাহার হাটুর কাছ হইতে গোড়ালি পর্যন্ত ফোলা। গায়ের চামড়া যেন তাহার আলগা হইয়া শুকাইয়া শক্ত ও কালো হইয়া উঠিয়াছিল, এখন বৃষ্টির জলে ভিজিয়া ভিজা জুতার চামড়ার মতো স্যাঁতসেঁতে দেখাইতেছে। একটু আগে বহুদূর হইতে অত জোরে হাঁক দিবার শক্তি সে কোথায় পাইয়াছিল ভাবিয়া কুবের অবাক হইয়া রহিল।
রাসু ঝিমাইযা পড়িতেছিল, ধনঞ্জয় জিজ্ঞাসা করিল, ময়নাদ্বীপ থেইকা আলি না রাসু?
হ!
পলাইয়া আইছস?
হ, বৈশাখ মাসে।
বৈশাখ মাসে? এতকাল কই ছিলি তুই?
নোয়াখালি ছিলাম। বিষুদবাবে আইলাম সুলপী। কমুনে আজানখুড়া, সগগল কমু। অখনে ক্ষুধায় মরি।—অ কুবিরদা, কিছু নি দিবার পার?
তখনকার মতো কৌতুহল নিবৃত্তির সম্ভাবনা নাই দেখিযা রাসুক সঙ্গে করিয়া তিনজনে গ্রামে ফিরিয়া গেল। ধনঞ্জয়ের বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছিবার আগেই রাসুর আবির্ভাবের বার্তা রাষ্ট্র হইয়া গেল জেলেপাড়ার সর্বত্র। কিছুক্ষণের মধ্যেই ধনঞ্জয়ের উঠান জেলেপাড়ার কৌতুহলী ছেলেমেয়ে স্ত্রীপুরুষে ভরিয়া উঠিল। সকলের চোখে অপার বিস্ময়। তিন বছর আগে সকলে যাহাকে মৃত্যুমুখে সঁপিয়া দিয়াছিল, প্রায় তিন বছর যাহাকে সকলে একরকম ভুলিয়াই ছিল, হঠাৎ সে আবার আসিল কোথা হইতে? রাসুর মামা আশি বছরের বুড়া পীতম মাঝিও ন্যুব্জ দেহ লইয়া লাঠিতে ভর দিয়া আসিয়া পড়িল। রাসু দাওয়ার উপরে চাটাইয়ে বসিয়া মুহ্যমানের মতো একদা-পরিচিত এই জনতার দিকে স্তিমিত নিস্তেজ দৃষ্টিতে চাহিয়া দেখিতেছিল, কাছে গিয়া ক্ষীণদৃষ্টি পীতম মাঝি তাহাকে অনেকক্ষণ ঠাহর করিয়া দেখিল। চিনিতে পারিয়া ভাবাবেগে হাত হইতে লাঠিটা খসিয়া যাওয়ায় হঠাৎ ভাগনের গায়ের উপরেই হুমড়ি খাইয়া পড়িয়া সে উঠিল কাঁদিয়া। হুমড়ি খাইয়া পড়িবার আঘাতে নয়, কাঁদিয়া উঠিল সে এই বলিয়া যে রাসু এক ফিরিয়া আসিল আর সকলে কই?
যে অনাহারের পীড়নে রাসু একদিন সপরিবারে ঘরছাড়া হইয়াছিল, দু মুঠ চাল দিয়া পীতম তাহা লাঘব করিবার কোনো চেষ্টাই করে নাই। তাই বলিয়া তার এই কান্না যে অশোভন হইল তা নয়। সেই দুর্দিনে মামার স্বাভাবিক উদাসীনতার স্মৃতি রাসুও মনের মধ্যে পুষিয়া রাখে নাই। শুধু সেই দুর্দিনের স্মৃতি নয়, সবই যেন সে এতক্ষণ ভুলিয়া ছিল, তাহার দুঃখ বেদনার সর্বাঙ্গীণ ইতিহাস। পীতমের কান্না শুনিয়া সেও হঠাৎ ডুকরাইয়া কাঁদিয়া উঠিল –আমি এক ফিরা আইলাম গো মামা, সবকটারে গাঙের জলে ভাসাইয়া দিয়া আমি একা ফিরা আইলাম।