- বইয়ের নামঃ পদ্মা নদীর মাঝি
- লেখকের নামঃ মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
- প্রকাশনাঃ বই সাগর
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস
পদ্মা নদীর মাঝি – ১

পদ্মা নদীর মাঝি
১
বর্ষার মাঝামাঝি।
পদ্মায় ইলিশ মাছ ধরার মরসুম চলিয়াছে।দিবারাত্রি কোন সময়েই মাছ ধরবার কামাই নাই।সন্ধ্যার সময় জাহাজঘাটে দাঁড়াইলে দেখা যায় নদীর বুকে শত শত আলো অনির্বাণ জোনাকির মত ঘুরিয়া বেড়াইতেছে।জেলে-নৌকার আলো ওগুলি।সমস্ত রাত্রি আলোগুলি এমনিভাবে নদীবক্ষের রহস্যময় ম্লান অন্ধকারে দুর্বোধ্য সঙ্কেতের মত সঞ্চালিত হয়।এক সময় মাঝরাত্রি পার হইয়া যায়।শহরে, গ্রামে, রেল-স্টেশনে ও জাহাজঘাটে শ্রান্ত মানুষ চোখ বুজিয়া ঘুমাইয়া পড়ে।শেষরাত্রে ভাঙা ভাঙা মেঘে ঢাকা আকাশে ক্ষীণ চাঁদটি উঠে।জেলে-নৌকার আলোগুলি তখনো নেভে না।নৌকার খোল ভরিয়া জমিতে থাকে মৃত সাদা ইলিশ মাছ।লন্ঠনের আলোয় মাছের আঁশ চকচক করে,মাছের নিষ্পলক চোখগুলিকে স্বচ্ছ নীলাভ মণির মত দেখায়।
কুবের মাঝি আজ মাছ ধরিতেছিল দেবগঞ্জের মাইল দেড়েক উজানে। নৌকায় আরও দুজন লোক আছে, ধনঞ্জয় এবং গণেশ। তিনজনেরই বাড়ি কেতুপুর গ্রামে। আরও দু-মাইল উজানে পদ্মার ধারেই কেতুপুর গ্রাম।
নৌকাটি বেশী বড় নয়। পিছনের দিকে সামান্য একটু ছাউনি আছে। বর্ষা-বাদলে দু-তিনজনে কোনরকমে মাথা গুঁজিয়া থাকিতে পারে। বাকি সবারটাই খোলা। মাঝখানে নৌকার পাটাতনে হাত দুই ফাঁক রাখা হইয়াছে। এই ফাঁক দিয়া নৌকার খোলের মধ্যে মাছ ধরিয়া জমা করা হয়। জাল ফেলিবার ব্যবস্থা পাশের দিকে। ত্রিকোন বাঁশের ফ্রেমে বিপুল পাখার মত জালটি নৌকার পাশে লাগানো আছে। জালের শেষসীমায় বাঁশটি নৌকার পার্শ্বদেশের সঙ্গে সমান্তরাল। তার দুই প্রান্ত হইতে লম্বা দুইটি বাঁশ নৌকার ধারে আসিয়া মিশিয়া পরস্পরকে অতিক্রম করিয়া নৌকার ভিতরে হাত দুই আগাইয়া আসিয়াছে। জালের এ দুটি হাতল। এই হাতল ধরিয়া জাল উঠানো এবং নামানো হয়।
গভীর জলে বিরাট ঠোঁটের মত দুটি বাঁশে-বাঁধা জাল লাগে। দড়ি ধরিয়া বাঁশের ঠোঁট হাঁ-করা জাল নামাইয়া দেওয়া হয়। মাছ পড়িলে খবর আসে জেলের হাতের দড়ি বাহিয়া, দড়ির দ্বারাই জলের নীচে জালের মুখ বন্ধ করা হয়।
এ নৌকাটি ধনঞ্জয়ের সম্পত্তি। জালটাও তারই। প্রতি রাত্রে যত মাছ ধরা হয় তার অর্ধেক ভাগ ধনঞ্জয়ের, বাকি অর্ধের কুবের আর গণেশের। নৌকা এবং জালের মালিক বলিয়া ধনঞ্জয় পরিশ্রমও কম করে। আগাগোড়া সে শুধু নৌকার হাল ধরিয়া বসিয়া থাকে। কুবের ও গণেশ হাতল ধরিয়া জালটা জলে নামায় এবং তোলে, মাছগুলি সঞ্চয় করে। পদ্মার ঢেউয়ে নৌকা টলমল করিতে থাকে, আলোটা মিটমিট করিয়া জ্বলে, জোর বাতাসেও নৌকার চিরস্থায়ী গাঢ় আঁশটে গন্ধ উড়ালিয়া লইয়া যাইতে পারে না। একহাতে একখানি কাপড়কে নেংটির মত কোমরে জড়াইয়া ক্রমাগত জলে ভিজিয়া, শীতল জলোবাতাসে শীত বোধ করিয়া, বিনিদ্র আরক্ত চোখে লণ্ঠনের মৃদু আলোয় নদীর অশান্ত জলরাশির দিকে চাহিয়া থাকিয়া কুবের ও গণেশ সমস্ত রাত মাছ ধরে। নৌকা স্রোতে ভাসিয়া যায়। বৈঠা ধরিয়া নৌকাকে তারা ঠেলিয়া লইয়া আসে সেইখানে যেখানে একেবারে ঝাঁকের মধ্যে জাল ফেলিয়া বেশী মাছ উঠিয়াছিল। আজ খুব মাছ উঠিতেছিল। কিন্তু ভোরে দেবীগঞ্জে মাছের দর না জানা অবধি এটা সৌভাগ্য কিনা বলা যায় না। সকলেরই যদি এ রকম মাছের বড় ঝাঁক পড়ে দর কাল এত নামিয়া যাইবে যে বিশেষ কোন লাভের আশা থাকিবে না। তবে মাছের বড় ঝাঁক একই সময়ে সমস্ত নদীটা জুড়িয়া থাকে না, এই যা ভরসার কথা। বেশী মাছ সকলের নাও উঠিতে পারে।
কুবের হাঁকিয়া বলে, যদু হে এ এ এ–মাছ কিবা?
খানিক দূরের নৌকা হইতে জবাব আসে, জবর।
জবাবেব পব সে নৌকা হইতে পালটা প্রশ্ন করা হয়। কুবের হাঁকিয়া জানায় তাদেরও মাছ পড়িতেছে জবর।
ধনঞ্জয় বলে, সাঁঝের দরটা জিগা দেখি কুবের।
কুবের হাঁকিয়া দাম জিজ্ঞাসা করে। সন্ধ্যা বেলা আজ পৌনে পাঁচ, পাঁচ এবং সওয়া পাঁচ টাকা দবে মাছ বিক্রি হইয়াছে। শুনিয়া ধনঞ্জয় বলে, কাইল চাইরে নামবো। হালার মাছ ধইরা যুত নাই।
কুবের কিছু বলে না। ঝপ কবিয়া জালটা জলে ফেলিয়া দেয়। শরীরটা আজ তাহার ভালো ছিল না। তার স্ত্রী মালা তাকে বাহির হইতে বারণ করিয়াছিল। কিন্তু শরীরেব দিকে তাকাইবার অবসর কুবেবের নাই। টাকার অভাবে অখিল সাহার পুকুবটা এবারও সে জমা লইতে পারে নাই। সারাটা বছর তাকে পদ্মার মাছের উপরেই নির্ভর করিয়া থাকিতে হইবে। এ নির্ভরও বিশেয জোরালো নয়, পদ্মার মাছ ধরিবার উপযুক্ত জাল তার নাই। ধনঞ্জয় অথবা নড়াইলের যদুর সঙ্গে সমস্ত বছর তাকে এমনি ভাবে দুআনা চারআনা ভাগে মজুরি খাটিতে হইবে। ইলিশের মরশুম ফুরাইলে বিপুল পদ্মা কৃপণ হইয়া যায। নিজের বিরাট বিস্তৃতিব মাঝে কোনখানে সে যে তার মীন সন্তানগুলিকে লুকাইয়া ফেলে খুঁজিয়া বাহির করা কঠিন হইয দাঁড়ায়। নদীর মালিককে খাজনা দিয়া হাজার টাকা দামেব জাল যারা পাতিতে পারে তাদেব স্থান ছাড়িয়া দিয়া, এতবড়ো পদ্মার বুকে জীবিকা অর্জন করা তার মতো গরিব জেলের পক্ষে দুঃসাধ্য ব্যাপার। ধনঞ্জয় ও যদুর জোড়াতালি দেওয়া ব্যবস্থায় যা মাছ পড়ে তার দু-তিন আনা ভাগে কা্রও সংসার চলে না। উপার্জন যা হয় এই ইলিশের মরশুম। শরীর থাক আর যাক এ সময় একটা রাত্রিও ঘরে বসিয়া থাকিলে কুবেরের চলিবে না।