বাইরের এই অপূর্ব জোছনার সঙ্গে এই ঘটনা কেমন যেন মিশ খায় না। আমার মন খারাপ হয়ে গেল।‘
ঠিকানা নিয়ে কী করবি
নানাজান বললেন, ঠিকানা নিয়ে কী করবি?
চিঠি লিখব।
এতদিন পর চিঠি লেখার কথা মনে পড়ল?
আমি চুপ করে রইলাম। নানাজান একটু কেশে বললেন,
শরীরের হাল কেমন? জ্বর আছে?
জি, না।
নবু তোর কাছে চিঠি-ফিঠি লেখে।
জি লেখে।
পূজার বন্ধে বাড়ি আসবে বলে চিঠি লিখেছে আমার কাছে। বলতে বলতে নানাজান হঠাৎ কথা থামিয়ে বলেন,
লিলিরা আগে যেখানে থাকত এখন সেখানে নাই। নতুন ঠিকানা তো আমার জানা নাই। আচ্ছা, আমি খোঁজ নিয়ে বলব।
লিলি আপনার কাছে চিঠি লেখে নানাজান?
নানাজান একটু ইতস্তত করে বললেন, কম লেখে।
আশ্বিনের গোড়াতেই নবুমামা এসে পড়লেন।
তাকে দেখে আমার চোখে পলক পড়ে না। লম্বায় বেড়েছেন, স্বাস্থ্য ভাল হয়েছে। ঠোঁটের ওপর হালকা নীল গোঁফের রেখা। নবুমামা আমাকে দেখেই হৈ হৈ করে উঠলেন, তোর এ কি হাল রঞ্জু!
অসুখ করেছিল। আমার। আপনাকে আর চেনা যায় না মামা।
স্বাস্থ্য দেখেছিস? দেখ, হাতের মাসল টিপে দেখ।
মাসল টিপে দেখার দরকার পড়ে না। নবুমামার স্বাস্থ্য-সৌন্দর্য দেখে ঈৰ্ষা হয় আমার। লালমামি তো নবুমামাকে চিনতেই পারেন না, কে এসেছে ভেবে থতমত খেয়ে উঠে দাঁড়িয়েছেন। ওমনি নবুমামা খপ করে তার হাত চেপে ধরলেন। মামি বললেন,
নবু নাকি? তুমি তো বদলে গেছ।
মামি নবুমামাকে আজ প্রথম তুমি করে বললেন। নবুমামা হেসেই কূল পান না। হাসি থামিয়ে কোনমতে বললেন,
ভাবী, তুমি আগের মতই আছ। না, আগের মত নয়, আগের চেয়ে সুন্দর।
অনেক দিন পর নবুমামাকে দেখে কি যে ভাল লাগল! তাছাড়া, মামা এত বেশি বদলে গেছেন। কি করে সেও এক বিস্ময়। ছোটবেলায় দুজনকে তো একই রকম দেখাত। আমি পরম বিস্ময় নিয়ে নবুমামার পিছু পিছু ফিরতে লাগলাম। নবুমামার গল্প আব্বা ফুরোয় না। স্কুলের গল্প, স্কুলের বন্ধুদের গল্প। রাজশাহীর গল্প। এর মধ্যে রাজশাহী থেকে নাটোর রাজবাড়িতে গিয়েছিলেন তার গল্প। আমি শুনি আর অবাক হই।
নবুমামা ক্লান্ত হয়ে এসেছিলেন। দুপুবে খেয়ে-দোয়ে ঘুমিয়ে পড়ল। আমিও বেশ শুয়ে আছি কখন নবুমামা জাগবেন। সেই আশায়। ঘুম ভাঙতে ভাঙতে সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত। ছোট নানিজান এসে ডেকে তুললেন। দুজনে চলে গেলাম। লালমামির ঘরে। মামির প্রতি নবুমামার শৈশবেব যে টান ছিল তা দেখলাম। এতদিনের অদর্শনে এতটুকু কমেনি, ববং বেড়েছে।
লাল মামি বললেন, নবু, আমার ভীষণ মাথা ধরেছে, পরে গল্প কবব তোমাব সাথে। নবুমামা হো হো করে হাসেন।
না, গল্প এখনি করতে হবে। আর আগের মত তুই করে ডাকতে হবে।
এই বলে নবুমামা দাবজায় খিল এঁটে দিলেন। আমি অবাক হয়ে দেখলাম, নবুমামা রহস্যময ভঙ্গিতে তার প্যান্টের পকেটে হাত দিচ্ছেন,
তোমার জন্যে কি এনেছি, দেখ ভাবী।
বল তো দেখি কি? আন্দাজ কর।
লালমামি ভ্র কুঞ্চিত করলেন। নবুমামা বললেন,
ছোটবেলায় আমাদের সিগারেট খাইয়েছিলে। আজ আমি সিগারেট নিয়ে এসেছি। আজকে আবার খেতে হবে।
তুমি কি এর মধ্যেই সিগারেট ধরেছ নাকি?
না, ধরিনি। তোমার জন্য এনেছি।
বলেই নবুমামা নিজে একটা সিগারেট ধরিয়ে লালমামির দিকে তাকিয়ে হাসতে লাগলেন। লালমামি বললেন,
আমি সিগারেট খাব না।
খেতেই হবে।
নবুমামা জোর করে মামির মুখে সিগারেট গুঁজে দিলেন। থু ধু করে ফেলে দিয়ে মামি শুকনো গলায় বললেন,
তুমি বড়ো বেয়াড়া হয়ে গেছ নবু।
নবুমামা ভ্রক্ষেপ করলেন না। কায়দা করে সিগারেটের ধোয়া ছাড়তে লাগলেন। এক সময় বললেন,
ভাবী, তোমার কাছে আমি এত চিঠি লিখলাম, জবাব দাওনি কেন?
একটা তো দিয়েছি।
না, এবার থেকে সব চিঠির জবাব দিতে হবে।
এই বলে নবুমামা বেরিয়ে এলেন। বললেন, রঞ্জু, চল মাঠে বেড়াই। খুব বাতাস দিচ্ছে, মাঠে হাঁটলে খিদে হবে।
মাঠে সে রাতে প্রচুর জোছনা হয়েছে। চকচক করছে চারদিক। ঠাণ্ডা একটা বাতাস বইছে। নবুমামা চেঁচিয়ে বলল, কি জোছনা! খেতে ইচ্ছে হয়। মনে হয় কপি কপি করে খেয়ে ফেলি। নবুমামা মুখ হা করে খাবার ভঙ্গি করতে লাগল। বিস্মিত হয়ে আমি তার আনন্দ দেখলাম।
অনেক রাতে বাড়ি ফিরে দেখি বাদশা মামা জলচৌকিতে চুপচাপ বসে আছেন। নবুমামাকে দেখে নির্জীব কণ্ঠে শুধালেন,
কখন এসেছিস?
সকালে। তুমি কোথায় ছিলে?
বাদশা মামা বিড়বিড় করে কি বললেন, বোঝা গেল না। নবুমামা বললেন, তোমার কি হয়েছে?
বাদশা মামা এর উত্তরেও বিড়বিড় করলেন।
ভাত খেতে খেতে নবুমামা বললেন, বাদশা ভাইয়ের কি হয়েছে?
নানীজান বললেন, জাদু করেছে তাকে।
কে জাদু করেছে?
কে আবার; বউ।
নবুমামা রেগে গিয়ে বলল, কি সব সময় বাজে কথা বলেন।
নানীজান বললেন, কি যে গুণের বউ, তা কি আর এতদিনে জানতে বাকি আছে আমার? বাদশার দিকে চোখ তুলে তাকাতে পারি না।
লালমামি কখন যে নিঃশব্দে পেছনে এসে দাঁড়িয়েছেন জানতে পারিনি। ঠাণ্ডা গলায় বললেন, কে যাদু করেছে, মা?
নানীজান বললেন, বউ, তুমি চোখ রাঙিয়ে কথা বল কার সঙ্গে?
আমি চোখ রাঙিয়েছি?
তুমি কার ওপর গরম দেখাও বউ, রূপের দেমাগে তো পা মাটিতে পড়ে না। এদিকে আত্মীয়-স্বজনের কাছে মুখ দেখাতে পারি না আমি। বাঁজা মেয়েমানুষ বলে সারা দুনিয়ার লোকে তোমাকে ডাকে।
নবুমামা বললেন, মা, আপনি চুপ করেন।
কোন চুপ করব? কাকে ডরাই আমি? বাদশাকে আজ বললে কাল সে তিন তালাক দেয়।