এ সব কি দেখবে! না, না। বলে প্রথম দিকে প্রবল আপত্তি তুললেও শেষের দিকে তাকে কেমন নরম মনে হল। সুযোগ বুঝে নানীজান বলে চলেছেন, একদিনের মোটে ব্যাপার। আমোদ-আহাদ তো কিছু করে না।
না করে না, রাতদিনই তো আমোদ চলছে। আচ্ছা যাক। পালকি করে যেন যায়।
স্কুলঘরে স্টেজ সাজানো হয়েছে। হ্যাঁজাকের আলোয় ঝলমল করছে চারদিক। হ্যাঁরিকেন হাতে নিয়ে গ্রামের লোকজন আসছে। কাতারে কাতারে। পর্দায় আড়াল করা মেয়েদের জায়গায় তিল ধারনের ঠাই নেই। আমি আর নবুমামা বসেছি মেয়েদের সঙ্গে। ছোট নানী আর দুখালা চাদর গায়ে চুপচাপ বসে আছেন। নাটক শুরু হতে হতে রাত হয়ে গেল। বাদশা মামা সেজেছেন হিরণ্য রাজা। এমন মহান রাজা দীন-দুঃখীদের জন্য সমস্ত বিলিয়ে দিচ্ছেন। দুশ্চরিত্র মন্ত্রি ঘোট পাকাচ্ছে তলে তলে। রাজা আপন-ভোলা মানুষ, কিছু জানতেও পারছেন না। মন্ত্রমুগ্ধের মত দেখছি সবাই। এক সময় হিরণ্য রাজা মনের দুঃখে রাজপ্রাসাদ ছেড়ে বেরিয়ে পড়েছেন। রানীও তাঁর পিছু পিছু। নানীজান চমকে বললেন, মেয়ে কোথেকে এলো। কার মেয়ে?
ও হচ্ছে হারু দাদা, মেয়ে সেজেছে।
ওমা, হারু নাকি?
নানীজনের চোখে আর পলক পড়ে না। বিবেকের পাঠ করল আজমল। খালারা কাঁদতে কাঁদতে চাদর ভিজিয়ে ফেলল। শেষ দৃশ্যে হিরণ্য রাজা মন্ত্রীকে বলছেন–এই রাজ্য তুমি লাও ভাই। কাজ নাই রাজ্যপাটে, আমি বনবাসে যাব।
সেইখানে শান্তি অপার।
ছোট খালা বললেন, বেকুবটা মন্ত্রীকে মেরে ফেলে না কেন?
মন্ত্রী বলছে, দ্বন্দ্ব যুদ্ধ হোক রাজা, বৃথা তর্কে কোনো ফল নাই।
ঝন ঝন যুদ্ধ শুরু হয়ে গেল। নবুমামা উত্তেজনায় দাঁড়িয়ে পড়লেন। নানীজান পেছনে থেকে চেঁচাচ্ছেন, ও নবু বস, দেখতে পাচ্ছি না। বসে পড়। কী তীব্র উত্তেজনা! রাজার মৃত্যুতে চোখে জল। বাদশা মামার জয়জয়কার। কী পাঠাটাই না করলেন!
নানাজানও যে শেষ পর্যন্ত অভিনয় দেখবেন, তা কেউ ভাবিনি। পালকিতে খালারা উঠতে যাবে, এমন সময় তিনি এসে হাজির। বাদশা তো বড় ভালো করেছে। এই বলে পালকিতে উঠবার তাড়া দিয়ে তিনি চলে গেলেন হেডমাস্টার সাহেবের বাড়ি। সেখানে তার রাতের দাওয়াত।
বাড়ি গিযে দেখি মেহমানে বাড়ি ভর্তি। নন্দিপুর থেকে নানাজানের ফুপাতো বোন এসেছেন। ছেলেমেয়ে নিয়ে। সকাল-সকালই পৌঁছতেন, নৌকার দাঁড় ভেঙে যাওয়ায় দেরি হয়ে গেছে। আমি আর নবুমামা অবাক হয়ে গেলাম মেহমানদের মধ্যে অদ্ভুত সুন্দর একটি মেয়েকে দেখে। নানাজানের ফুপাতো বোনের বড় মেয়ে। ডাকনাম এলাচি। এমন সুন্দরও মানুষ হয়।
দু’মাসের ভেতর এলাচির সঙ্গে বিয়ে হয়ে গেল বাদশা মামার। আপাত কাৰ্যকারণ ছাড়াই যে সমস্ত ক্ষুদ্র ব্যাপার ঘটে তা-ই কেমন করে পরবর্তী সময়ে মানুষের সমস্ত জীবন বদলে দেয়, ভাবতে অবাক লাগে।
সে রাতে নাটক দেখে সবাই বাদশা মামার উপর মহাপ্রসন্ন ছিলেন। বাড়ি এসে দেখেন, ফুলেব মত একটি মেয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। বাদশার সঙ্গে এর বিয়ে হলে কেমন হয়? এই ভাবনা চকিতে খেলে গেল সবার মনে। এলাচি স্থায়ীভাবে নানাজানের বাড়িতে উঠে এলেন। নাম হয়ে গেল। লাল বউ, আমি ডাকতাম লাল মামি, নবুমামা ডাকত লাল ভাবী। টকটকে বর্ণ, পাকা ডালিমের মত গাল। আর কি নামেই-বা ডাকা যায়!
নবুমামা এবং আমি দুজনে একইসঙ্গে লালমামির প্রেমে পড়ে গেলাম! সদা ঘুর ঘুর করি, একটু যদি ফুট-ফরমাস করতে দেন এই আশায়। লালমামি কাকে বেশি খাতির করেন, আমাকে, না নবুমামাকে এই নিয়ে ঝগড়া হয়ে যায় দুজনের। স্কুলে যাবার পথে বইখাতা নামিয়ে হয় হাতাহাতি। লালমামির বড়ই খাবার ইচ্ছে হয়েছে, খেলা বন্ধ করে দুজনেই ছুটেছি ইন্দু সাহার বাড়ি। ইন্দু সাহার বাড়িতে দুটি বড়ই গাছ, মিষ্টি যেন গুড়। লালমামির ইচ্ছে হয়েছে কামরাঙ্গা খাবেন, ঝাল লংকা মাখিয়ে। বাড়ির পেছনে বিস্তৃত বন। এখানে-ওখানে গাছ আছে লুকিয়ে। দুজনেই গেছি বনে।
মেয়েরা খুব সহজেই ভালবাসা বুঝতে পারে। লালমামি আমাদের দুজনকেই বুঝে ফেললেন। পোষা বেড়ালের মত আমরা তার সঙ্গে বেড়াই। মোহরের মা বলে, পুলা দুটা মাইয়া স্বভাবের, এসব ভাল না গো।
আমি আর নবুমামা তখন নির্বাসিত হয়েছি পাশের ঘরে। কতটুকুই বা দূরে? লালমামি হাসছেন, আমরা শুনতে পারছি। লালমামি বলছেন, উঁহু, চুল ছিঁড়ে গেল। আমরা উৎকৰ্ণ হয়ে শুনছি। লালমামি যদি কখনো বলেছেন, এই যা, আজ খাওয়ার পানি-আনি নাই, ওমনি নবুমামা তড়াক করে লাফিয়ে পড়েছে বিছানা ছেড়ে, ভাবী, পানি নিয়ে আসছি আমি।
একঘেয়ে কোনো আকর্ষণেই আকর্ষণ থাকে না। মায়ের প্রতি মানুষের অন্ধ ভালবাসা ফিকে হয়ে আসে একঘেয়েমির জন্যেই। ভাই-বোনের ভালবাসার ধরনও বদলাতে থাকে। লালমামির প্রতি আমাদের ভালবাসা ফিকে হওয়ার কোনো ভয় ছিল না। তার মত বিচিত্র স্বভাবের মেয়ে আমি পরবর্তী জীবনে আর একটিমাত্র দেখেছিলাম।
যে কথা বলছিলাম–লালমামি আমাদের বিচিত্রভাবে আকর্ষণ করলেন। হয়ত আমি আর নবুমামা দুজনে বসে আছি তাঁর ঘরে। মামি হুকুম করলেন, নবু, দরজা বন্ধ করে দে। খোল, এবার আলমারি খোল। রাজার পোশাকটা বের করত।
আমি আঁৎকে উঠে বলেছি, বাদশা মামা মেরে ফেলবে। ঠোঁট উল্টে মামি তাচ্ছিল্যের ভঙ্গি করেছেন, নে, তুই এই মুকুটটা পরে ফেলে। নবু, তুই কী সাজবি, সন্ন্যাসী?
নবুমামা বললেন, তুমি কী সাজবে আগে বল?