টগরের সঙ্গে যখন গল্প করলাম। সে নিচের ঠোট উল্টে দিয়ে বলল, এত মিথ্যে কথাও তোমার আসে? ছিঃ ছিঃ!
মিথ্যে নয় বলে তাকে কিছুতেই বিশ্বাস করাতে পারলাম না। বড় নানীজনকে নিয়ে কত বিচিত্র সব গল্প আছে। তাঁর ভূতে পাওয়ার গল্পটিও আমি টগরকে শুনিয়েছিলাম।
বড় নানীজনের অভ্যোস ছিল, সন্ধ্যাবেল পুকুরে সাঁতার কেটে নাওয়া। তখন কার্তিক মাস। অল্প-অল্প হিম পড়েছে। নানীজান গিয়েছেন অভ্যেসমত গোসল সারাতে। সূর্য ডুবে অন্ধকার হল, তার ফিরবার নাম নেই। মোহরের মা হ্যাঁরিকেন জ্বালিয়ে পুকুরঘাটে খোঁজ নিতে গিয়ে দেখে, কোমর-জলে দাঁড়িয়ে তিনি থর থর করে কাপছেন। মোহরের মা ভয় পেয়ে বলল, কি হয়েছে গো?
নানীজান অস্পষ্টভাবে টেনে টেনে বললেন, ও মোহরের মা, টেনে তোল আমাকে, আমি উঠতে পারি না, কত চেষ্টা করলাম উঠতে।
টগর বলল, হিস্টিরিয়া ছিল তোমার নানীর। ভূত-ফুত কিছু নয়। তোমার বড় নানীজানের। ছেলেমেয়ে হয়নি নিশ্চয়ই।
না, হিস্টিরিয়া ছিল না তার। আর ছেলেমেয়ে ছিল না, তাও নয়। বড় নানীজনের একটি মাত্র মেয়ে ছিল, হাসিনা। সবাই ডাকত হাসনা। তিনি আমার আর লিলির মা।
হাসনা তিন মাসের একটি শিশুকে কোলে করে আর চার বছরের একটি মেয়ের হাত ধরে এ বাড়িতে এসে উঠেছিল। কোনো একটি বিশেষ ঘটনার কাল্পনিক চিত্র যদি অসংখ্যাবার আঁকা যায়, তাহলে এমন একটি সময় আসে যখন সেই কাল্পনিক চিত্রকেই বাস্তব বলে ভ্রম হয়। আমি মাধ। এ বাড়িতে আসার ঘটনাটি চোখের সামনে স্পষ্ট দেখতে পাই। প্রতিটি ডিটেল অত্যন্ত সূক্ষ্ম।
তখন সন্ধ্যা হয়ে গেছে। হ্যাঁরিকেন আর কুপি মিলিয়ে পনেরো-বিশটি বাতি জ্বলছে এখানেওখানে। বিল থেকে ধরে আনা মাছের গাদার চারপাশে বলে বউ-ঝিরা মাছ কুটিছেন আর হাসিতামাশা করছেন। হাসনা এল ঠিক এ সময়ে। অত্যন্ত জেদী ভঙ্গিতে সে উঠোনে এসে দাঁড়াল। তাকে দেখতে পেয়ে সবাই অবাক হয়ে নেমে এল উঠোনে। খড়ম খট খট করে নানাজান নেমে এলেন দোতলা থেকে আর হাসনা শুকনো চোখে দেখতে লাগল সবাইকে।
হাসনার বিয়েতে সারা গাঁর দাওয়াত ছিল। হিন্দুরা মুসলমান বাড়িতে এখন ইচ্ছে করে মাংস খেতে আসেন, তখন আসতেন না। হিন্দুদের জন্যে ঢালাও মিষ্টির ব্যবস্থা। নাম-করা কারিগর রমেশ ঠাকুর দু’দিন আগে বাড়িতে ভিয়েন বসালেন।
আত্মীয়-কুটুম্বের জায়গা হয় না ঘরে, নতুন ঘর উঠল এদিকে-ওদিকে। গাঁয়ের দারোগা খেতে এসে আঁৎকে উঠে বলল, করছেন কি খান সাহেব? এ যে রাজরাজাদের ব্যাপার! নানাজান হাসিমুখে বললেন, প্রথম মেয়ের বিয়ে, সবাইকে না বললে খারাপ দেখায়, সবাই আত্মীয়-স্বজন।
গ্রামের নিতান্ত গরিব চাষীও মেয়ের বিয়েতে দুবিঘা জমি বিক্রি করে ফেলে, হালের গুরু বেঁচে দেয়। আর নানাজান তখন টাকার উপর শুয়ে।
হাতি আনতে লোক গেল হালুয়াঘাট। সেখানে কালুশেখের দুটি মাদী হাতি আছে। বন থেকে–কাঠের বোঝা টেনে নামায়। বিয়ের আগের রাতে মাহুতকে ঘাড়ে করে মাতৃ এসে দাঁড়াল। উৎসাহী ছেলেমেয়েরা কলাগাছের পাহাড় বানিয়ে ফেলল উঠোনে। মাহুতের সঙ্গে দুদণ্ড কথা বলার জন্য কী আগ্রহ সবার। মাহুত সাহেব কী একটু তামাক খেতে ইচ্ছে করবেন?
হাতির পিঠে চড়ে বর এসে নামল। লোকে লোকারণ্য। ভিড়ের চাপে গেট ভেঙে পড়ে, এমন অবস্থা। জরীর মালায় বরের মুখ ঢাকা। কিছুই দেখা যাচ্ছে না। কলম পড়ানোর আগে জরীর মালা সরানো হবে না। সে-ও রাত একটার আগে নয়। বসে থাকতে থাকতে বিরক্ত হয়ে বর বন্ধুদের নিয়ে সিগারেট খেতে গেল বাইরে। আমনি হৈ-হৈ করে উঠল। সবাই, দেখেছি! কী রঙ! যেন সাহেবদের রঙ। রাজপুত্র এসে দাঁড়িয়েছে যেন!
লিলিরও বিয়ে হল এই বাড়িতে। দশ-পনের জন বন্ধু নিয়ে রোগামত একটি ছেলে বসে রইল বাইরের ঘরে। নিতান্ত দায়সারা গোছের বিয়ে। ভাল ছেলে পাওয়া গেছে, এই তো ঢের। তাছাড়া গয়না-টয়নাও তো নেহায়েত কম দেওয়া হয়নি। মায়ের গলার হার, হাতের ছ’গাছা চুরি, নানীজান দিলেন কানের দুল, ছোট নানীজান নাম-লেখা আংটি। কবুল বলতে গিয়ে লিলি তবু কেঁদে-কেটে অস্থির। নানাজানের প্রবল ধমকের এক ফাঁকে কখন যে কবুল বলেছে তা শুনতেই পেল না কেউ।
ন’মাইল পালকি করে গিয়ে ট্রেন। ট্রেন পর্যন্ত উঠিয়ে দিয়ে আসব আমি আর নবুমামা। বেডিংপত্তর নিয়ে দুজন কমলা আগে আগে চলে গিয়েছে। পালকির সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে পারি না, বারবার পিছিয়ে পড়ি। নবুমামা বললেন, পায়ে ফোস্কা পড়ে গেছে, আমি জুতা খুলে ফেললাম।
সজনিতলা এসে পান্ধি থামল। বেহারারা জিরোবে। পান-তামুক খাবে। লিলি পালকির ফাঁক থেকে হাত বাড়িয়ে ডাকল, এই রঞ্জু, দুষ্টামি করবি না তো?
না।
আমার জন্য কাঁদবি না তো?
না, কাঁদব না।
কাঁদবি না কী রে গাধা? বোনের জন্য না কাঁদলে কার জন্য কাঁদবি? আমার কী আর কেউ আছে?
ট্রেন ছেড়ে দিল।
এই বাড়ি ঐ বাড়ি করে ট্রেন দ্রুত সরে যাচ্ছে। নবুমামা কাঁদছেন হু হু করে। বেহার এসে বলল, দুজনে এসে বসেন পালকিতে, ফিরিয়ে নিয়ে যাই।
লিলিকে ট্রেনে উঠিয়ে দিয়ে এসে আমার বয়স যেন হঠাৎ করে বেড়ে গেল। মনে হল কিছু কিছু চিরন্তন রহস্য যেন বুঝতে পারছি।
স্কুলের প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী
আশ্বিন মাস আসতেই সাজ সাজ পড়ে গেল স্কুলে।
স্কুলের প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী। গান, তো হবেই, সেই সঙ্গে নাটক হবে স্টেজ বেঁধে। হিরণ্য রাজা নাটকের নাম। হিরণ্য রাজার পাঠ করেছেন বাদশা মামা। উৎসাহের সীমা নেই। আমাদের। খালারাও ঘ্যান ঘ্যান করতে লাগলেন নাটক দেখবার জন্যে। মেয়েদের জন্যে পর্দাঘেরা আলাদা জায়গা করা হয়েছে। এ বাড়ির মেয়েরা আগে কখনো নাটক-ফাটক কিছুই দেখেনি। দেখবার সখ খুব। ছোট নানী আর্জি নিয়ে গেলেন নানাজনের কাছে।