এ সমস্ত মিলিয়ে তৈরি হয়েছে আমার শৈশব। গাঢ় রহস্যের মত ঘিরে রয়েছে আমার চারদিক। আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি, অল্প বয়সের ভয়-কাতর একটি ছেলে তার নিত্যসঙ্গী নবুমামার হাত ধরে ঘুমুতে যাচ্ছে, দোতলার ঘরে। নবুমামা বলছেন, তুই ভিতরের জানালা দুটি বন্ধ করে আয়, আমি দাঁড়াচ্ছি বাইরে। আমি বলছি, আমার ভয় করছে, আপনি ও আসেন। মামা মুখ ভেংচে বলছেন, এতেই ভয় ধরে গেল! টেবিলে রাখা হ্যাঁরিকেন থেকে আবছা অ্যালো আসছে। আমি আর নবুমামা কুকুর-কুণ্ডুলি হয়ে লেপ মুড়ি দিয়ে গুয়ে আছি। নবুমামা শুতে-না-শুতেই ঘুম; একা একা ভয়ে আমার কান্না আসছে। এমন সময় বাড়ির ভেতব থেকে হৈচৈ শোনা গেল। শুনলাম, খড়ম পায়ে খটখট করে কে যেন এদিকে আসছে; মোহরের মা মিহি সুরে কাঁদছে, আমি অনেকক্ষণ সেই কান্না শুনে এক সময় ঘুমিয়ে পড়লাম। জানাতেও পারিনি সে-রাতে আমার মা মারা গিয়েছিলেন।
সে-রাতে আমার ঘুম ভেঙেছিল ফজরের নামাজের সময়। জেগে দেখি, বাদশা মামা চুপচাপ বসে আছেন চেয়ারে। আমাকে বললেন, আর ঘুমিয়ে কি কারবি, আয় বেড়াতে যাই। আমরা সোনাখালির খাল পর্যন্ত চলে গেলাম; সেখানে পাকা পুলের উপর দুজনে বসে বসে সূর্যোদয় দেখলাম। প্রচণ্ড শীত পড়েছিল সেবার। কুয়াশার চাদরে গাছপালা ঢাকা। সূর্যের আলো পড়ে শিশির-ভেজা পাতা চকচক করছে। কেমন অচেনা লাগছে সব কিছু। মামা অন্যমনস্ক ভাবে বললেন, রঞ্জু, আজ তোর খুব দুঃখেব দিন। দুঃখের দিনে কি করতে হয় জানিস?
না।
হা হা করে হাসতে হয়। হাসলেই আল্যা বলেন, একে দুঃখ দিয়ে কোনো লাভ নেই। একে সুখ দিতে হবে। বুঝেছিস?
বুঝেছি।
বেশ, তাহলে হাসি দে আমার সঙ্গে।
এই বলে তিনি হো হো করে হেসে উঠলেন। বাদশা মামার খুব মোটা গলা ছিল। তার হাসিতে চারদিক গম গম করতে লাগল। আমি ও তাঁর সঙ্গে গলা মিলালাম। বাদশা মামা বললেন, আজ আর বাসায় ফিরে কাজ নেই, চল শ্রীপুর যাই। সেখানে আজ যাত্রা হবে। আমি মহাখুশি হয়ে তাঁর সঙ্গে চললাম।
কতদিনকার কথা, কিন্তু সব যেন চোখের সামনে ভাসছে।
বাদশা মামার সঙ্গে
বাদশা মামার সঙ্গে আমার কখনো অন্তরঙ্গতা হয়নি। অথচ আমরা একই ঘরে থাকতাম। দোতলার সবচেয়ে দক্ষিণেব ঘরে দুটো খাটের একটিতে বাদশা মামা, অন্যটিতে আমি আর নবুমামা। সারাদিন বাদশা মামার দেখা নেই। রাতে কখন যে ফিরতেন, তা কোনোদিনই জানিনি। ঘুম ভাঙার আগে-আগেই চলে গেছেন। কোনো কোনো বাতে ঘুম ভেঙে গেলে দেখেছি গুনগুন করে কী পড়ছেন। যেদিন মেজাজ ভালো থাকত সেদিন খুশি-খুশি গলায় বলতেন, রঞ্জু, শুন তো দেখি, কেমন হচ্ছে বলবি। আমি হঠাৎ ঘুম-ভাঙা অবস্থায় কী হচ্ছে ঠিক বুঝতে পারছি না। মামা দাঁড়িয়ে হাত নেড়ে নেড়ে বলা শুরু করেছেন–
এ রাজ্যপাঠ যায় যাক,
কোনো ক্ষতি নেই
কিন্তু ত্ৰিদীব তুমি
কোথা যাবে?
ভরাট গলা ছিল তার, সমস্ত ঘর কোপে কেঁপে উঠত। মাঝপথে থেমে গিয়ে বলতেন, দাঁড়া, পোশাকটা পরে নেই, পোশাক ছাড়া ভাল হয় না। তোল, নবুকে ঘুম থেকে তোল। নবুমামার ঘুম ভাঙালেই প্রথম কিছুক্ষণ নাকি সুরে কাঁদত। বাদশা মামা বিরক্ত হয়ে বলতেন,–গাধা! দেখ না কী করছি। তারপর দুজনেই হাঁ করে তাকিয়ে থাকি বাদশা মামার দিকে। আলমারি খুলে তিনি মুকুট বের করেছেন, জড়িদার পোশাক পরেছেন। তারপর একা একাই অভিনয় করে চলেছেন। আমরা দুই শিশু মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে আছি।
বাদশা মামা প্রথম থেকেই আমাদের কাছে দূরের মানুষ। যিনি জরির পোশাক পরে রাতদুপুরে আমাদের অভিনয় দেখান, তিনি কাছের মানুষ হতে পারেন না। বাড়ির মানুষের কাছেও তিনি দল-ছাড়া। খুব ছোটবেলায় নানাজান তাকে একবার বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছিলেন। যে ছেলে স্কুল পালিয়ে যাত্ৰাদলে চলে যায়, নানাজানের মতো লোক তাকে ঘরে রাখতে পারেন না। খবর শুনে ছোট নানিজান খাওয়া-দাওয়া ছাড়লেন। মরো-মারো অবস্থা! নানাজান লোক পাঠিয়ে বাদশা মামাকে ফিরিয়ে আনলেন। সেই থেকে তিনি বাদশা মামাকে ঘাটান না! বাদশা মামাও আছেন আপন মনে।
বাদশা মামা আমার শিশুচিত্তকে প্রবলভাবে আকর্ষণ করেছিলেন। শিল্পীর সব সময়ই শিশুদের আকর্ষণ করে। হয়ত শিশুরাই প্রতিভার খবর পায় সবার আগে, কিন্তু বাদশা মামা দারুণ অসুখী ছিলেন। যে সামাজিক পদমর্যাদা তার ছিল তা নিয়ে যাত্ৰাদলের মানুষদের সঙ্গে সহজে মিশতে পারতেন না। অথচ তাঁর চিন্তা-ভাবনার সমস্ত জগৎ যাত্ৰাদলকে ঘিরে। মাঝে-মাঝেই তাঁকে দেখেছি, বারান্দায় চেয়ার পেতে চুপচাপ বসে আছেন। যদি গিয়ে বলেছি,
মামা কি করেন?
কিছু না।
সকাল থেকে সন্ধ্যা হয়েছে, মামা তেমনি বসেই আছেন। কেউ যদি গিয়ে বলেছে,
বাদশা, তোর কি হয়েছে রে?
কিছু না।
মাঝে-মাঝেই এ রকম হত তাঁর। নানাজান তখন ক্ষেপে যেতেন। ছোট নানিজনকে ডেকে বলতেন, ভং ধরেছে নাকি? শক্ত মুগুড় দিয়ে পিটালে ঠিক হয়, বুঝেছ? নানিজান মিনমিন করে কী কৈফিয়ত দিতে চেষ্টা করেন। তারপর একসময় দেখা যায়, তিনি বাড়ির পেছনে দাঁড়িয়ে বিনিয়ে-বিনিয়ে কাঁদছেন।
নানাজানকে সবাই ভয় করতাম আমরা। দোতলা থেকে একতলায় তিনি নেমে এলে একতলা নীরব হয়ে যেত। খুব কম বয়সী শিশু, যাদের এখনো বিচার-বুদ্ধিও হয়নি, তারাও নানাজানকে দেখলে ফ্যাকাসে হয়ে যেত। ভয়টাও বহুলাংশে সংক্ৰামক।
ভোরবেলায় ঘুম ভাঙত নানাজানের কোরান পাঠের শব্দে। মোটা গলা, টেনে টেনে একটু অনুনাসিক সুরে অনেকক্ষণ ধরে পড়তেন। তখন মাথায় থাকত লাল রংয়ের ঝুটি ওয়ালা একটা ফেজ টুপি। খালি গা, পরনে সিন্ধের ধবধবে সাদা লুঙ্গি। হাতলওয়ালা চেয়ারে বসে ঝুকে ঝুকে অনেকক্ষণ ধরে পড়তেন। পড়া শেষ হয়ে গেলে কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থাকতেন। ছোট নানিজান এই সময়ে জাম-বাটিতে বড় এক বাটি চা তৈরি করে নিয়ে যেতেন। নানাজান চুকচুক করে অনেকটা সময় নিয়ে চা খেতেন। তারপর নিজের হাতে হাঁসের খোয়াড় খুলে দিতেন। পাশেই মুরগির খোয়াড়, সেটিতে হাতও দিতেন না। হাঁসগুলি ছাড়া পেয়ে দৌড়ে যেত পুকুরের দিকে। তিনিও যেতেন পিছু পিছু। সমস্তই রুটিন বাধা, একচুলও এদিক-ওদিক হবার জো নেই।