তাছাড়া সে সময় আমি প্রেমেও পড়েছিলাম। অচিনপুরের এই কাহিনীতে সে প্রেমের উল্লেখ না করলেও চলে, কারণ তার ভূমিকা নেই এখানে। তবে প্রচণ্ড পরিবর্তন হচ্ছিল আমার মধ্যে এইটুকু বলা আবশ্যক।
নবুমামার স্কুল ফাইন্যালের রেজাল্ট হল তখন। খুবই ভাল রেজাল্ট। ডিস্ট্রিক্ট স্কলারশিপ পেলেন। কলেজে ভর্তি হবার জন্যে টাকা-পয়সা নিয়ে নবুমামা রওনা হলেন। নানাজানের ইচ্ছা ছিল নবুমামা যেন আনন্দমোহন কলেজে ভর্তি হন। কিন্তু নবুমামার ইচ্ছে প্রেসিডেন্সি কলেজ।
নবুমামার বিয়ের তারিখ ঠিকই থাকল। নবুমামা নিজেও একদিন মেয়ে দেখে এলেন। সফুরা খালা যখন বললেন, মেয়ে পছন্দ হয়েছে? নবুমামা ঘাড় নেড়ে সায় দিয়েছে।
বারোই ভাদ্র তারিখে নবুমামা চলে গেলেন। আর তেরোই ভদ্র বাদশা মামা শ্ৰীপুর থেকে আধ-পাগল হয়ে ফিরে এলেন। আমি ভাসা ভাসা ভাবে শুনলাম, লালমামি শ্বশুরবাড়ি ফিরে যাবার নাম করে নবুমামার সঙ্গে চলে গিয়েছেন।
কেউ যেন জানতে না পারে সেই জন্যে বাদশা মামাকে ঘরে বন্ধ করে রাখা হল। তার ঠিক নেই, কখন কাকে কি বলে বসেন। ছোট নানিজানের ফিটের ব্যারাম হয়ে গেল। সফুরা খালাকে দেখে কোন পরিবর্তন নজরে পড়ে না। শুধু তার চোখে কালি পড়েছে। মুখ শুকিয়ে তাকে দেখায় বাচ্চা ছেলের মত।
নানাজান সেই বৎসরেই হজ করতে গেলেন; যাওয়ার আগে সব সম্পত্তি বিলি বন্দোবস্ত হল। বাদশা মামাকে সব লিখে-পড়ে দিয়ে গেলেন।
একটি প্রচণ্ড প্রাচীন বটগাছ যেন চোখের সামনে শুকিয়ে উঠেছে। সবুজ পাতা ঝরে যাচ্ছে, কাণ্ড হয়েছে অশক্ত। আমি তাই দেখছি তাকিয়ে তাকিয়ে। শৈশবের যে অবুঝ ভালবাসায় নানাজানের বাড়িটিকে আমি ঘিরে রেখেছিলাম, সেই ভালবাসা করুণ নয়নে চেয়ে আছে আমার দিকে। কিন্তু আমি তো এখানের কেউ নই। একদিন চুপচাপ চলে যাব। কেউ জানতেও পারবে না রঞ্জু নামের আবেগপ্রবণ ছেলেটি কোথায় চলে গেল।
এ বাড়ির সব কিছুই বদলে গেছে। লাল ফেজটুপি পরা নানাজান সূর্য উঠার আগেই উঠোনের চেয়ারে এসে আর বসে না। “ফাবিয়ায়ে আলা রাব্বি কুমা তুকাজ্জিবান” ঘুম-ঘুম চোখে অর্ধ-জাগ্রত কানে কতবার শুনেছি এই সুর। এখন সকালটা বড়ো চুপচাপ।
ভোরের আলোয় মনের সব গ্লানি কেটে যায়। আমি চাই এ বাড়ির সবার মনের গ্লানি কেটে যাক। নবুমামা ফিরে এসে আগের মত জোছনা দেখে উল্লাসে চিৎকার করুক। কি জোছনা! খেতে ইচ্ছে করে। সফুরা খালা ঠিক আগের মত লাঠি হাতে পাখি উড়ে গেল বলে এ সংসারের যাবতীয় দুঃখ-কষ্ট উড়িয়ে দিক। বাদশা মামা তার সাজ-পোশাক পরে হিরণ্য রাজার পাঠ করুক। কিন্তু তা আর হবে না, তা হবার নয়। আমি সংসারের মন্থর স্রোতে গা এলিয়ে দিলাম। কারো সঙ্গেই আজ আমার যোগ নেই। দিন কেটে যেতে লাগল।
টিনের কানেস্তারায় বাড়ি পড়েছে
টিনের কানেস্তারায় বাড়ি পড়েছে। উচ্চকণ্ঠে কি যেন ঘোষণা করা হচ্ছে। কৌতূহলী হয়ে দাঁড়াতেই দেখি, বাদশা মামা বিব্রত মুখে সারা গায়ে চাদর জড়িয়ে হাঁটছেন। তার আগে আরেকজন টিনে বাড়ি দিয়ে দিয়ে উচ্চকণ্ঠে কি বলছে। আমি বললাম, কি ব্যাপার মামা?
কিছু না, কিছু না।
ঢোল দিচ্ছে কে? আপনি নাকি?
হুঁ।
কিসের জন্যে?
বাদশা মামা দাঁড়িয়ে পড়লেন। জড়িত কণ্ঠে বললেন, রহমত পাগলের জন্যে ঢোল দিচ্ছি, যদি কেউ পায় তাহলে পাঁচ টাকা পুরস্কার।
কেন, কি হয়েছে?
বাদশা মামা এড়িয়ে যেতে চাইলেন। কিন্তু আমি ততক্ষণে তার হাত চেপে ধরেছি। মামা অসহায়ভাবে তাকালেন আমার দিকে। আমি দৃষ্ট গলায় বললাম, বলেন কি ব্যাপার।
রঞ্জু, পাগলটাকে খেদিয়ে দেবার পর থেকে যত অশান্তি শুরু হয়েছে। ফিরিয়ে আনলে যদি সব মিটে।
মামা আমার হাত ছাড়িয়ে সামনে এগিয়ে গেলেন। বাদশা মামা আরো অনেক রকম পাগলামি করতে লাগলেন। নানাজানের একটি আম-কাঁঠালের প্রকাণ্ড বাগান ছিল। জলের দরে সেটি বেঁচে দিলেন। বিক্রির টাকা দিয়ে নাকি মসজিদ করবেন। ছোট নানীজান কাঁদো-কাঁদো হয়ে বললেন, এসব কী রে বাদশা?
বাদশা মামা কৈফিয়তের ভঙ্গিতে বললেন, তিনি নাকি স্বপ্নে দেখেছেন সাদা পোশাক পরা এক জ্যোতির্ময় পুরুষ তাকে বললেন, মসজিদ কর, সব ঠিক হবে। ছোট নানীজান বললেন, বাদশা, তুই মিথ্যা কথা বলছিস। বাদশা মামা মাথা নিচু করে চলে গেলেন। মসজিদের জন্য ইট পুড়ানো হতে লাগল। ময়মনসিংহ থেকে রাজমিস্ত্রি আসল। বিরাট মিলাদ মহফিলের মধ্যে মসজিদের কাজ শুরু হল।
নানাজানের দুটি বিল ছিল। বিলের মাছ থেকে পয়সা আসত বিস্তর। সেই টাকায় সংসার খরচ গিয়েও বেশ মোটা অংশ জমত। বিল দুটি একইসঙ্গে হাতছাড়া হয়ে গেল। কী ভাবে হল কেউ বলতে পারল না। নানীজান সারাদিন চোখের পানি ফেলতে লাগলেন।
রহিম শেখ একসঙ্গে বেশ কয়েকটি মামলা রুজু করল। সমস্তই মিথ্যা মামলা। বাদশা মামা নির্বিকার বসে আছেন মসজিদের সামনে। দেখছেন কী করে ইটের পর ইট বিছিয়ে ভিত তৈরি হচ্ছে। মামলার তদবীরের জন্য ছোট নানীজানকে নিয়ে আমিই যাওয়া-আসা করতে লাগলাম। দীর্ঘদিন মামলা চলল। দুটিতে জিত হল আমাদের, একটি রহিম শেখ পেল।
নানাজান হজ থেকে ফিরে এলেন এই সময়ে। সংসারের তখন ভরাডুবি ঘটেছে। রোজকার বাজারের টাকাতেও টানাটানি পড়তে শুরু করেছে। নানাজান কিছুই বলল না। ছয় মাসেই তার বয়স ছবছর বেড়ে গেছে। চোখের দৃষ্টি হয়েছে নিম্প্রভ, একা একা হাঁটতে পারেন না। লাঠিতে ভর না দিয়ে দাঁড়াতে পারেন না। চোখের সামনে সংসারকে ভেঙে পড়তে দেখলেন। তবু সকালেবেলায় কোরাওন শরীফ ধরে বিলম্বিত সুরে পড়তে লাগলেন। “ফাবিয়ায়ে আলা রাব্বিকুমা তুকাজ্জিবান।” অতএব তুমি আমার কোন কোন নিয়ামত অস্বীকার করিবে?