বিষয় আর কিছু নয়। লালমামি ঘুমোতে গিয়ে দেখেছেন, তার বালিশের নিচে শাড়ির পাড়ের টুকরো, মাথার চুল, একখণ্ড ছোট হাড়–এই জাতীয় জিনিস সুতো দিয়ে বেঁধে রেখে দেয়া। বশীকরণের জিনিসপত্র হয়ত। সেই থেকেই এ বিপত্তি।
নবুমামাকে স্টেশনে দিয়ে আসতে আমি সঙ্গে চলেছি। রাত দুটোয় ট্রেন। সন্ধ্যাবেলা খেয়েদেয়ে রওনা হয়েছি। হ্যাঁরিকেন দুলিয়ে একটি কামলা যাচ্ছে আগে আগে। ঠাণ্ডা হাওয়া বইছে হুহু করে। নবুমামা আর আমি গল্প করতে করতে যাচ্ছি। হঠাৎ মামা বললেন,
ও তোকে বলা হয়নি, লিলির সঙ্গে দেখা হয়েছিল আমার। শান্তাহার স্টেশনে। প্লাটফরমে বসেছিল, আমি তাকে চিনতে পারিনি। হঠাৎ ডাকল,
নবুমামা, না?
নবুমামা কিছুক্ষণ থেকে বললেন, খুব গরিব হয়ে গেছে। রোগা হয়েছে খুব। ময়লা কাপড়চোপড়। এমন খারাপ লাগল দেখে।
লিলির বাবার সঙ্গে দেখা হয়নি?
না, লিলি বলল, আমাকে দেখে লজ্জা পেয়ে নাকি লুকিয়ে আছে কোথায়।
আর কিছু বলেনি?
তোর কথা জিজ্ঞেস করল। তার অবস্থা একটু ভালো হলেই তোকে নাকি তার কাছে নিয়ে যাব।
নবুমামা বললেন, তোর মন খারাপ হয়েছে?
হ্যাঁ।
আমারো হয়েছে। বিয়ের পর যখন লিলি শ্বশুরবাড়ি গেল, মনে আছে, রঞ্জু?
আছে।
ট্রেনে উঠে কি কাঁদাটাই-না কাঁদল।
নবুমামা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললেন।
খুব অর্থকষ্টে পড়লাম
সেবার আমি খুব অর্থকষ্টে পড়লাম।
স্কুলের বেতন দিতে হয়। মাঝে-মধ্যে চাঁদা দিতে হয়। আগে নবুমামা যখন দিতেন সে সঙ্গে আমারটাও দিয়ে দিতেন। এখন আমি একলা পড়েছি। নিজ থেকে কারো কাছে কিছু চাইতে পারি না। পোশাকের বেলায়ও তাই। নবুমামার কাপড়-জামা বরাবর পরে এসেছি। লিলিও প্রায়ই বানিয়ে দিয়েছে। অসুবিধে হয়নি কিছু। এখন অসুবিধে হতে লাগল। কি করব ভেবে পাই না। বাদশা মামার কাছে কিছু চাইতে লজ্জা করে। আমি খুব মুশকিলে পড়ে গেলাম। নিজেকে অবাঞ্ছিত ভাবা খুব কষ্ট ও লজ্জার ব্যাপার। আমার ভারি কষ্ট হতে লাগল। খুব ইচ্ছে হতে লাগল লিলির কাছে চলে যাই। কিন্তু তার কাছে চিঠি লিখে জবাব পাই না। পুরোনো জায়গা ছেড়ে তারা নতুন যেখানে গিয়েছে, তার ঠিকানাও জানায়নি কাউকে।
তাছাড়া নানাজানের সংসারেও নানারকম অশান্তি শুরু হয়েছে। তাঁর জন্মশক্রি হালিম শেখ জমি নিয়ে মামলা শুরু করেছে। টাকা খরচ হচ্ছে জলের মত। বৃদ্ধ বয়সে নানাজানকে কোর্ট-কাঁচারিতে দৌড়াদৌড়ি করতে হচ্ছে। বাদশা মামাকে দিয়ে তো কোন কাজ করাবার উপায় নেই। তিনি জড় পদার্থের মত হয়ে গিয়েছেন। সুফি সাহেবের বাড়ি থেকে ফিরবার পর বেশ কিছুদিন ধর্ম-কর্ম নিয়ে ছিলেন। লোকে ভালই বলেছে। এখন সেসব ছেড়েছেন। নেশা-ভাঙও নাকি করেন আজকাল।
সফুরা খালাকে নিয়েও অনেক রকম অশান্তি হচ্ছে। তখন তিনি দেখতে দেখতে বড় হয়ে উঠেছিলেন। তার বিয়ের কথাবার্তাও হচ্ছে। একবার সব ঠিকঠাক হয়ে গেল। ছেলের বাবা মেয়ে দেখে মহাখুশি। এমন ভাল স্বভাবের মেয়ে সে নাকি তার সমস্ত জীবনে দেখেনি। কিন্তু বিয়ে হল না। সফুরা খালাকে নিয়ে নানারকম রটনা। তার না-কি মাথা খারাপ। রাতে-বিরেতে মেয়ে না-কি পুকুরঘাটে হেঁটে বেড়ায়। একবার কোনো মেয়ে সম্পর্কে এ জাতীয় কথা ছড়িয়ে পড়াটা খুব খারাপ লক্ষণ। এ নিয়ে ঘরেও অশান্তির শেষ নেই। নানিজান বিনিয়ে-বিনিয়ে গানের মত সুরে কাঁদেন। মাঝে মাঝে আপন মনে বলেন, আমার নসীব, বিয়ে করালাম ছেলে, বউটা বাঁজা–মেয়েটাও আধা-পাগলা।
কিন্তু যাকে নিয়ে এত অশান্তি সেই সফুরা খালা নির্বিকার। আমি একদিন সফুরা খালাকে জিজ্ঞেস করলাম, খালা, আপনি নাকি রাতে-বিরেতে একা একা ঘুরে বেড়ান?
খালা মৃদু গলায় বললেন, এক একা পুকুর ঘাটে বসে থাকতে এত ভাল লাগে!
তাকে নিয়ে চারিদিকে যে এত অশান্তি সেদিকে কিছুমাত্র খেয়াল নেই। আছে আপন মনে। তার জন্যে আমার খুব কষ্ট হতে শুরু করল। খালাকে আমি তখন ভালবেসে ফেলেছি।
আসলে খালাকে আমি একটুও বুঝে উঠতে পারিনি। যাবতীয় দুর্বোধ্য বস্তুর জন্যে মানুষের স্বাভাবিক আকর্ষণ থাকে। সেই জন্যেই তার প্রতি আমার প্রবল ভালবাসা গড়ে উঠল। আমার ইচ্ছে হল, তার সঙ্গে আমার খুব বন্ধুত্ব গড়ে উঠুক।
কিন্তু তিনি নিজের চারদিকে একটি দেয়াল তুলে দিয়েছিলেন। এই দেয়াল ভেদ করে তার নৈকট্য লাভের উপায় নেই। নিজের সৃষ্টি জগতেই তিনি ডুবে আছেন। বাইরের প্রতি একটুও খেয়াল নেই। ইচ্ছে হল তো চলে গেলেন পুকুর পাড়ে। একা বেড়াতে গেলেন বাগানে।
এসব দেখে-শুনে কেন জানি না। আমার একটা ধারণা হয়েছিল, সফুরা খালা বড় রকমের দুঃখ পাবে জীবনে। এ রকম মনে করবার কোন কারণ ছিল না। কিন্তু আমার মনে হত, একেই হয়ত intuition বলে।
পরবর্তী জীবনে দেখেছি। আমার ধারণা অক্ষরে অক্ষরে মিলে গেছে। দুঃখ এসেছে এবং অত্যন্ত সহজভাবে জীবনের প্রাত্যহিক ঘটনার মত দুঃখকে তিনি গ্রহণ করেছেন। এই মেয়ের গল্প আমি অন্য কোথাও বলব। আজ শুধু হাসান আলীর কথাটাই বলি।
হাসান আলী বাজারে কিসের যে ঠিকাদারী করত। ছাব্বিশ-সাতাশ বছর বয়স। ভীষণ গরিব। নানাজানের কি রকম যেন আত্মীয়। থাকত নানাজানের বাংলাঘরে (বাড়ির বহির্মহলে অতিথি অভ্যাগতদের জন্যে নির্মিত ঘরকেই বাংলাঘর বলা হত)।
অত্যন্ত নিরীহ ধরনের ছেলে। যতক্ষণ ঘরে থাকত। ততক্ষণ বসে বসে হিসেবপত্র করত। আমরা সে সময় তার ঘরে হাজির হলে বিনা কারণে আঁৎকে উঠত। তারপরই সহজ হওয়ার চেষ্টা করতে গিয়ে চোখ লাল করে এক বিশ্রি কাণ্ড। প্রতি হাটবার দিন দেখতাম সে অল্প কিছু মিষ্টি কিনে এনেছে। মিষ্টি আনা হয়েছে নানাজানের বাড়ির মানুষদের জন্যেই কিন্তু দেওয়ার সাহস নেই। অনেক রাতে কাউকে ডেকে হয়ত ফিসফিস করে বলল, একটু মিষ্টি এনেছিলাম। বাড়ির প্রায় মানুষই তখন ঘুমে।