লালমামি বললেন, তাই বলেন না কেন? ঐ তো বসে আছে চৌকিতে। যান, গিয়ে বলেন।
নবুমামা আর আমি দোতলায় উঠে দেখি মামি চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছেন বারান্দায়। আমাদের দেখে উঁচু গলায় বললেন,
নবু, তুমি কালকে আমাকে বাবার বাড়িতে রেখে আসবে?
নবুমামা চুপ করে রইলেন।
নবুমামা এক মাস রইলেন আমাদের সঙ্গে। তিনি অনেক গল্পের বই নিয়ে এসেছিলেন, প্রতিদিন সেগুলি পড়া হত। লোহারামের কেচ্ছা বলে একটি বই ছিল। এমন হাসির! নবুমামা পড়তেন, আমি আর লালমামি শুনে হেসে গড়াগড়ি। ছোট নানীজান এক একদিন রেগে ভূত হতেন।
আস্তে হাসতে পার না বউ? তোমার শ্বশুর শুনলে কি হবে?
মোহরের মা আমাদের শুনিয়ে শুনিয়ে বলত–
যত হাসি তত কান্না
কহে গেল রাম সন্না।
নবুমামা শুনতে পেলে বলতেন, মোহরের মা, তোমার রাম সন্নাকে এই বইটা একটু পড়তে দিও। দেখি ব্যাটা হাসে কি কাঁদে।
একদিন হাসির শব্দ শুনে লাজুক পায়ে সফুরা খালা এসে হাজির। দরজার ওপাশ থেকে ফিকফিক করে বলছে,
ভাবী, তোমরা কি নিয়ে হাসছ?
গল্প শুনে হাসছি। হাসির গল্প।
সফুরা খালা ভেতরে এসে দাঁড়িয়ে মিটমিট হাসি হাসতে লাগলেন। যেন আমাদের কোনো গোপন অভিসন্ধি টের পেয়ে গিয়েছেন। তারপর আগের মত ফিকফিক গলায় বললেন,
হাসির গল্প আমার ভাল লাগে না।
তবু তিনি অনেক্ষণ পর্যন্ত বসে বসে নবুমামার গল্প পড়া শুনলেন। তারপর বললেন, চল না, সবাই মিলে দীঘির ঘাট থেকে বেড়িয়ে আসি। এখন তো আর লোকজন নেই।
সেদিন থেকে আমাদের রুটিন হল, গল্প-টল্প পড়ার পর দীঘির ঘাটে বেড়াতে যাওয়া। বেড়াতে বেড়াতে একদিন নবুমামার উল্লাসের কোনো সীমা থাকত না। স্কুল থেকে শিখে আসা একটা হিন্দি গান বেসুরো গলায় ধরে বসতেন। প্রথম লাইনটি বোধ হয় এরকম ছিল
“মাটি মে পৌরণ
মাটি মে শ্রাবণ
মাটি মে তেন বন যায়গা।”
পাখির ডানায় ভর করে সময় কাটতে লাগল। অবশ্যি বেড়াতে এসে মাঝে মধ্যে লালমামির ভীষণ মেজাজ খারাপ হয়ে যেত। সেগুলি ঘটত তখনি যখন মামি দেখতে পেতেন বাদশা মামা ঘাটের উল্টোদিকে চুপচাপ বসে আছেন। দেখে মনে হয়, যেন মানুষ নয়, উইয়ের টিবি। এতটুকু নড়াচড়াও নেই।
দেখতে দেখতে নবুমামার ছুটির দিন ফুরিয়ে গেল। আমার মনে হতে লাগল, একা একা আমার থাকতে হলে আমি আর বঁচিব না। যতই যাওয়ার দিন এগিয়ে আসে ততই আমার কষ্ট বাড়তে থাকে। যাবার ঠিক আগের দিন সন্ধ্যাবেলা ভারি মন নিয়ে লালমামির ঘরে বসে আছি। নবুমামাও কথা বলছেন না। এমন সময় নিচে থেকে কানাবিবি ডাকল, ও এলাচি বেগম! ও এলাচি বেগম!
লালমামি বললেন, আসছি, কেন ডাকে দেখে না।
নবু মামা বললেন–তোমার নাম এলাচি কেমন ভাবী?
আমার মুখে সব সময়-এলাচির গন্ধ থাকে, এই জন্যেই এলাচি নাম।
নবু মামা এগিয়ে এসেছেন, আগে তো কোনোদিন বলনি–শুঁকে দেখতাম! দেখি ভাবী, মাথাটা একটু নিচু করত।
কি পাগলামি কর নবু।
বলার আগেই নবু মামা লালমামির মাথা ঝাপটে ধরেছে এবং হৈ হৈ করে উঠেছে। আরে সত্যি তাই। এলাচির গন্ধ।
ছোট নানীজান ঢুকলেন এ সময়, শুকনো গলায় বললেন, ও বউ, তোমাকে এক ঘণ্টা ধরে ডাকছে কানাবিবি। কানে শুনতে-টুনতে পাও তো?
লালমামি বললেন, কি জন্যে ডাকছে?
সে যে তোমাকে গলায় আর কোমরে বাঁধবার জন্যে তাবিজ দিয়েছিল, সেগুলি কি করেছ?
ফেলে দিয়েছি।
কোন ফেলে দিয়েছ?
তাবিজ দিলে কি হবে?
নানীজান রেগে আগুন হয়ে বললেন, কি, অত বড়ো সাহস তোমার বউ? আল্লার কোরআন কালামকে অবিশ্বাস। রোজা নাই, নামায নাই! বেহায়া বেপর্দা মেয়ে!
নবুমামা বললেন, মা, আপনি চুপ করেন।
না, চুপ করব কেন? বউ শেষ কথা আমার, তাবিজ দিবা কি-না কও।
লালমামি বললেন, আপনার ছেলেকে জিজ্ঞেস করেন। সে যদি বলে তাবিজ দিলেই আমার ছেলেমেয়ে হবে, তাহলে দিব।
এমন সময় নিচে হৈচৈ শুনা গেল। আমি আর নবুমামা দৌড়ে গিয়ে দেখি, রহমত মিয়া শিকল খুলে কিভাবে যেন বেরিয়ে পড়েছে। হাতে শিকল নাচাচ্ছে, আর বলছে কাঁচা খাইয়া ফেলামু! কাঁচা খাইয়া ফেলামু!
লোকজন ঘিরে ফেলেছে তাকে। কাছে যেতে সাহস পাচ্ছে না। দু’একজন লম্বা বাঁশ বাগিয়ে ধরে আছে। নানাজান বললেন,
কেউ ওরে মারবে না, খবরদার। সাবধানে ধর।
বহু কসরত করতে হল ধরতে গিয়ে। শিকলের বাড়ি খেয়ে হারিস সর্দার তো প্ৰায় মরোমরো। নানাজান বললেন, যাও, নৌকায় করে পাগল হারামজাদাটাকে এক্ষুণি নন্দিপুরের বাজারে ছেড়ে দিয়ে আসো! এঁটো কাঁটা খেয়ে বেশ বেঁচে থাকবে।
ঘাটে নৌকা তৈরি ছিল। বহু উৎসাহী সহযাত্রী তৈরি হয়ে পড়ল। একটি জলজ্যান্ত পাগলকে অন্যগ্রামের বাজারে ছেড়ে আসা এ্যাডভেঞ্চারের মত।
পাগল তো কিছুতেই নৌকায় উঠবে না। চোঁচামেচি চিৎকার করে বাড়ি মাথায় তুলেছে। কিন্তু নৌকায় উঠেই তার ভাবান্তর হল। হাত ডুবিয়ে দিল নদীর পানিতে, তারপর খুশিতে হেসে ফেলল।
আহা! পাগলটার কারবার দেখে বড়ো মায়া লাগে রে।
তাকিয়ে দেখি, ঘাটের উপর বসে থেকে বাদশা মামা আফসোস করছেন। তার চোখ স্নেহ ও মমতায় চক চক করছে।
পরবর্তী দু’দিন বাড়ির আবহাওয়া অত্যন্ত উত্তপ্ত রইল। নবু মামা যে সকালে চলে যাবেন সে সকালে লালমামির সঙ্গে কানাবিবির একটা ছোটখাটো সংঘর্ষ হয়ে গেল। ঘুম ভেঙেই শুনি লালমামী বলেছেন–
এ কানাবিবির কাজ। কানাবিবি, তোমার এমন সাহস।
কানাবিবি বলছে–
বাড়ির বউ মানুষ কেমন গলায় কথা কয় গো।