‘যদি?’
‘হ্যাঁ। সারারাত নাও উঠতে পারি, কিছু ঠিক নেই। বেশ বালির বিছানা পাতা আছে। বসতে কষ্ট হলে আপনি শুতে পারবেন। বৃষ্টি নামলে কষ্ট হবে।’
হেরম্ব অভিভূত হয়ে বলল, ‘তারপর কি হবে?’
‘এখান থেকে স্টেশনে গিয়ে গাড়িতে উঠব। আপনার কলেজ অনেকদিন খুলে গেছে। আর বেশি কামাই করলে চাকরি যাবে।’
হেরম্ব কথা বলতে পারল না।
সুপ্রিয়া বলল, ‘চাকরি গেলে চলবে না, আমাদের টাকার দরকার হবে। ছোট বাড়িতে আমি থাকতে পারব না। সাত-আটখানা ঘর আর খুব বড় খোলা ছাদ থাকা চাই।’
সুপ্রিয়ার এই অন্তিম আবেদন।
ভীরু হেরম্ব পকেট হাতড়ে চুরুট বার করে। অনেকক্ষণ সময় নিয়ে চুরুটা ধরিয়ে বলল, ‘টিকিটের টাকা আনতে একবার কিন্তু আশ্রমে যেতে হবে, সুপ্রিয়া।’
সমস্ত রাত্রি সমুদ্রের ধারে কাটিয়ে পরদিন সকালে তাদের কলকাতা চলে যাবার মতো বৃহৎ সিদ্ধান্ত গ্রহণের সঙ্গে টিকিটের টাকার জন্য চিন্তিত হওয়া এত বেশি তুচ্ছ যে, হেরম্ব ভাবতেও পারল না, সুপ্রিয়া বুঝবে না। এ শুধু তার সময়োচিত গভীর পরিহাস, সুপ্রিয়ার প্রস্তাবকে এমনিভাবে দুৰ্বল হেরেম্বের হেসে উড়িয়ে দেওয়া। সুধিয়া কিন্তু সত্য সভাই তার এই কথাকে স্বীকারোক্তি বলে ধরে নিল।
‘তার দরকার নেই, আমার গায়ে গহনা আছে।‘
একটু চিন্তা করে হেরম্ব বক্তব্য স্থির করে নিল।
’শোন, সুপ্রিয়া। তোর বিয়ের সময় তোকে একটা উপহারও কিনে দিই নি। আর আজ তোর গয়না বিক্রির টাকায় কলকাতা যাব? এমন কথা তুই ভাবতে পারলি! একবার তোর ভয় হল না, লজ্জায় ঘৃণায় আমি তাহলে চলন্ত ট্রেন থেকে লাফিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করব?’
সুপ্রিয়ার হাত এতক্ষণে হয়তো অবশ হয়ে এসেছিল, হাত মুচড়ে তার শরীরের আশ্ৰয়াচুত উৰ্ব্বভাগ হেরম্বের কোলে হুমড়ি দিয়ে পড়লে অস্বাভাবিক হত না। কিন্তু সে সোজা হয়েই বসল। স্তব্ধ নিশ্চল, কাঠের মূর্তির মতো। রূপাইকুড়ায় হেরম্বের সঙ্গে বেড়াতে গিয়ে শুকনো ঘাসে-ঢাকা মাঠে সে এমনিভাবে বসেছিল। হেরম্বের মনে আছে। তখন সূৰ্য অস্ত গিয়ে সন্ধ্যা হয়েছিল। আজ সূৰ্যাস্তের সূচনামাত্র হয়েছে। ছোট একটি মেঘ এত জোরে ছুটে আসছে যে, সূৰ্যাস্তের আগেই সূর্যকে ঢেকে ফেলবে। সুপ্রিয়ার মুখ থেকে আকাশে দৃষ্টিকে সরিয়ে নিয়ে যেতে যেতে হেরম্বের মুখও বিবৰ্ণ স্নান হয়ে গেল। দুহাতে ভর দিয়ে সে বসেছে। দুই করতলে সূক্ষ্ম শীতল বালির স্পর্শ অনুভব করে তার মনে হল, যে পৃথিবীর সবুজ তৃণাচ্ছাদিত হওয়ার কথা, তার আগাগোড়া হয়ে গেছে মরুভূমি।
অপরাধীর মতো মন্থরপদে হেরম্ব আশ্রমে ফিরে এল। অন্ধকার বাগান পার হয়ে বাড়ির রুদ্ধ দরজায় সে করাঘাত করল আস্তে। তারপর আনন্দের নাম ধরে ডাকল। অভিশপ্ত দেবদূতের মতো মর্তের প্রবাস সাঙ্গ করে সে যেন স্বর্গের প্রবেশ-পথে সসঙ্কোচে এসে দাঁড়িয়েছে। দরজা খোলার জোরালো দাবি জানাবার সাহসও নেই।
আলো হাতে এসে দরজা খুলে আনন্দ নীরবে একপাশে সরে দাঁড়াল। হেরম্ব মৃদুস্বরে বলল, ‘দেরি করে ফেলেছি, না?’
‘কোথায় ছিলে এতক্ষণ?’
‘সমুদ্রের ধারে খানিকক্ষণ বেড়িয়ে মন্দিরে গিয়েছিলাম।’
‘তাঁর বাড়ি যাও নি–সকালে যিনি এসেছিলেন?’
‘গিয়েছিলাম। তিনি আমার সঙ্গে সমুদ্রের ধারে বেড়াতে এলেন। তঁকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে। ঘুরতে ঘুরতে মন্দিরের সামনে এসে হাজির হয়েছি। মন্দিরে উঠে একটু বসলাম। মনটা ভালো ছিল। না, আনন্দ।’
‘কেন?’
‘তিনি বললেন, আমায় তিনি ভালবাসেন। আমি ভালবাসি না বলায় মনে খুব ব্যথা পেলেন। কারো মনে ব্যথা দিলে মন খারাপ হয়ে যায় না?’
দরজা বন্ধ করার জন্য আনন্দ হেরম্বের দিকে পিছন ফিরল। হেরন্ধের মনে হল, এই ছুতায় সে। বুঝি মুখের ভাব গোপন করছে। দরজায় খিল দিয়ে আনন্দ ঘুরে দাঁড়াতে বোঝা গেল, হেরম্বের অনুমান সত্য নয়। আনন্দ কখনো কিছু গোপন করে না।
‘তিনি অনেকদিন থেকে তোমায় ভালবাসেন, না?’
‘তাই বললেন।’
দুজনে তারা হেরম্বের ঘরে গেল। মালতীর কোনো সাড়াশব্দ নেই। সবগুলি আলো আজ জ্বালা হয় নি, বাড়িতে আজ অন্ধকার বেশি, স্তব্ধতা নিবিড়। আলগোছে মেঝেতে আলোটা নামিয়ে রেখে আনন্দ বলল, ‘আমার ভালবাসা দুদিনের!’
হেরম্ব অনুরাগ দিয়ে বলল, ‘কেন তুমি কেবলি দিনের হিসাব করছি আনন্দ?’
কথাগুলি হঠাৎ যেন আক্রমণ করার মতো শোনাল। আনন্দ থাতমত খেয়ে বলল, ‘না, তা করি নি। এমনি কথার কথা বললাম।’
হেরম্ব বিষণ্ণভাবে মাথা নাড়ল।’কথার কথা কেউ বলে না, আনন্দ, আজ পর্যন্ত কারো মুখে আমি অর্থহীন কথা শুনি নি। তোমার ঈর্ষা হয়েছে।’
হেরম্বকে আশ্চৰ্য করে দিয়ে সহজভাবে আনন্দ এ কথা স্বীকার করল, ‘কেন তা হয়? আমার মন ছোট বলে?’
‘ঈর্ষা খুব স্বাভাবিক, আনন্দ, সকলের হয়।’
‘সকলের হোক, আমার কেন হবে?’
প্রশ্নটা হেরম্ব ঠিক বুঝতে পারল না। এ যদি আনন্দের অহঙ্কার হয় তবে কোনো কথা নেই। কিন্তু সে যদি সরলভাবে বিশ্বাস করে থাকে যে তার অসাধারণ প্রেমে ঈর্ষারও স্থান নেই, তাহলে হয়তো তাকে অনেকক্ষণ বকতে হবে। বলতে হবে–তোমার খিদে পায় না আনন্দ? মাঝে মাঝে প্রকৃতি তোমাকে শাসন করে না? হিংসাকে তেমনি প্রকৃতির নিয়ম বলে জেনো।
হেরম্ব কথা বলল না দেখে আনন্দ বোধহয় একটু ক্ষুন্ন হল। যেখানে দাঁড়িয়ে ছিল সেখানেই মেঝেতে সে বসল। তাকে চৌকিতে উঠে বসতে বলার মতো মনের জোর হেরম্ব আজ খুঁজে পেল না। সমুদ্রতীরের কলরব থেকে দূরে চলে আসার পর তার মনে যে স্তব্ধতার সৃষ্টি হয়েছিল, এখনো একটা ভারি আবরণের মতো তা তার মন চাপা দিয়ে রেখেছে। সুপ্রিয়ার সেই হাতে ভর দিয়ে বসবার শিথিল ভঙ্গি মনে পড়ে। আসন্ন সন্ধ্যায় সুপ্রিয়া স্থলিত পদে তার পরিত্যক্ত গৃহে প্রবেশ করার পর অন্ধকার পথে দাঁড়িয়ে তার অন্তরের অমৃত পিপাসাকে ছাপিয়ে যে কোটি ক্ষুধিত কামনার হাহাকার উঠেছিল মাটির মানুষ হেরম্বকে এখনো তা আচ্ছন্ন করে রেখেছে। তার দেহ শোকে অবসন্ন, মৃত্তিকার কীটদংশনে বিপন্ন তার মন।