মনে মনে শ্যামা বড় কষ্ট পাইল। অভাব অনটনের অভিজ্ঞতা জীবনে তাহার পুরোনো হইয়া আসিয়াছে, এমন দিনও তো গিয়াছে যখন সে ভালো করিয়া দেহের লজ্জাও আবরণ করিতে পারে নাই, কিন্তু আজ পর্যন্ত চারটি সন্তানের কোনো বড় সাধ শ্যামা অপূর্ণ রাখে নাই–আকাশের চাদ চাহিবার সাধ নয়, শ্যামার ছেলেমেয়ে অসম্ভব আশা রাখে না; শ্যামার মততা গরিবের পক্ষে পূরণ করা হয়তো কিছু কঠিন এমনি সব সাধারণ শখ, সাধারণ আব্দার। বিধান একবার সাহেবি পোর্শক চাহিয়াছিল, তাদের ক্লাসের পঁচ-ছটি ছেলে যে রকম বেশ ধরিয়া স্কুলে আসে, দোতলার ঘরের জন্য ইট সুরকি কিনিয়া শ্যামা তখন ফতুর হইয়া গিয়াছে। তবু ছেলেকে পোশাক তো সে কিনিয়া দিয়াছিল।
শ্যামার চোখে আজকাল সব সময় একটা ভীরুতার আভাস দেখিতে পাওয়া যায়। শীতলের উপরেও কোনোদিন সে নিশ্চিন্ত নির্ভর রাখতে পারে নাই, কমল প্রেসের চাকরিতে শীতল যখন ক্ৰমে ক্ৰমে উন্নতি করিতেছিল তখনন নয়, তবু তখন মনে যেন তাহার একটা জোর ছিল। আজ সে জোর নষ্ট হইয়া গিয়াছে। চোরের বৌ? জীবনে এ ছাপ তাহার ঘুচিবে না, স্বামীর অপরাধে মানুষ তাহাকে অপরাধী করিয়াছে, কেহ বিশ্বাস করিবে না, কেহ সাহায্য দিবে না, সকলেই তাহাকে পরিহার করিয়া চলিবে। যদি প্রয়োজনও হয় ছেলেমেয়েদের দুবেলার আহার সংগ্রহ করিবার সঙ্গত উপায় খুঁজিয়া পাইবে না, বন্ধুবান্ধব আত্মীয়স্বজন সকলে যাহাকে এড়াইয়া চলিতে চায়, নিজের পায়ে ভর দিয়া দাঁড়াইবার চেষ্টা সে করিবে কিসের ভরসায়? বিধবা হইলেও সে বোধহয় এতদূর নিরুপায় হইত না। দু বছর পরে শীতল হয়তো ফিরিয়া আসিবে, হয়তো আসিবে না। আসিলেও শ্যামার দুঃখ সে কি লাঘব করিতে পারিবে? নিজের প্রেস বিক্রয় করিয়া কতকাল শীতল অলস অকৰ্মণ্য হইয়া বাড়ি বসিয়াছিল সে ইতিহাস শ্যামা ভোলে নাই। তবু তখন শীতলের বয়স কম ছিল, মন তাজা ছিল। এই বয়সে দু বছর জেল খাটিয়া আসিয়া আর কি সে এত বড় সংসারের ভার গ্রহণ করিতে পারিবে? নিজেই হয়তো সে ভার হইয়া থাকিবে শ্যামার।
এক আছে মামা। সেও আবার খাটি একটি রহস্য, ধরাছোঁয়া দেয় না। কখনো শ্যামার আশা হয় মামা বুঝি লাখপতিই হইতে চলিয়াছে, কখনো ভয় হয় মামা সর্বনাশ করিয়া ছাড়িবে। সংসারে শ্যামা মানুষ দেখিয়াছে অনেক, এরকম খাপছাড়া অসাধারণ মানুষ একজনকেও তো সে স্থায়ী কিছু করিতে দেখে নাই। সংসারে সেটা যেন নিয়ম নয়। সাধারণ মোটা-বুদ্ধি সাবধানী লোকগুলিই শেষ পর্যন্ত টিকিয়া থাকে, শীতলের মতো যারা পাগলা, মামার মতো যারা খেয়ালি, হঠাৎ একদিন দেখা যায় তারাই ফঁকিতে পড়িয়াছে। জীবন তো জুয়াখেলা।
স্কুল খুলিবার কয়েকদিন পরে শঙ্কর দার্জিলিং হইতে ফিরিয়া আসিল। শ্যামার সাদর অভ্যর্থনা বোধহয় তাহার ভালো লাগিত, একদিন সে দেখা করিতে আসিল শ্যামার সঙ্গেই! শ্যামা দেখিয়া অবাক, পকেটে ভরিয়া সে দার্জিলিঙের কয়েক রকম তরকারি লইয়া আসিয়াছে। বিধান তখন দোকানে গিয়াছিল, হাতের কাজ ফেলিয়া রাখিয়া শ্যামা শঙ্করের সঙ্গে আলাপ করিল। বকুল নামিয়া আসিল নিচে, মার গা ঘেঁষিয়া বসিয়া বড় বড় চোখ মেলিয়া সে সবিস্ময়ে শঙ্করের দার্জিলিং বেড়ানোর গল্প শুনিল। শুধু বিধানকে নয়, শঙ্কর বকুলকেও ভালবাসে। কেবল সে বড় লাজুক বলিয়া বিধানের কাছে যেমন বকুলের কাছে তেমনি ভালবাসা কোথায় লুকাইবে ভাবিয়া পায় না। পকেটে ভরিয়া সে কি শ্যামার জন্য শুধু তরকারিই আনিয়াছে? মুখ লাল করিয়া বকুলের জিনিসও সে বাহির করিয়া দেয় : কে জানিত দাৰ্জিলিং গিয়া বকুলের কথা সে মনে রাখিবে?
শ্যামা বড় খুশি হয়। সোনার ছেলে, মাণিক ছেলে! কি মিষ্টি স্বভাব? আম কাটিয়া শ্যামা তাহাকে খাইতে দেয়, তারপর রঙিন স্ফটিকের মালা গলায় দিয়া বকুল গলগল করিয়া কথা বলিতে আরম্ভ করিয়াছে দেখিয়া হাসিমুখে কাজ করিতে যায়, পাঁচ মিনিট পরে দেখিতে পায় দুজনে দোতলায় গিয়াছে। রানীকে শোনাইয়া শ্যামা বলে, বড় ভালো ছেলে রানী, একটু অহঙ্কার নেই। … তারপর দোতলায় দুমদাম করিয়া ওদের ছোটাছুটির শব্দ ওঠে, বকুলের অজস্ৰ হাসি ঝরনার মতো নিচে ঝরিয়া পড়ে, এ ওর পিছনে ছুটিতে ছুটিতে একবার তাহারা একতলাটা পাক দিয়া যায়। দুরন্ত মেয়েটার পাল্লায় পড়িয়া লাজুক শঙ্করও যেন দুরন্ত হইয়া উঠিয়াছে।
পরদিন বিধান স্কুলে চলিয়া গেলে শ্যামা বিষ্ণুপ্রিয়ার সঙ্গে দেখা করতে গেল। দাসী তখন স্নানের আগে বিষ্ণুপ্রিয়ার চুলে গন্ধ-তেল দিতেছিল, চওড়া পাড় কোমল শাড়িখানা লুটাইয়া বিষ্ণুপ্রিয়া আনমনে বসিয়াছিল শ্বেতপাথরের মেঝেতে, কে বলিবে সে-ও জননী। এত বয়সে ওর রং দেখিয়া মনে মনে শ্যামার হাসি আসে–প্রথম কন্যার জন্মের পর ও আবার সন্ন্যাসিনী সাজিয়াছিল। আজ প্রতিদিন তিনটি দাসী মিলিয়া ওই স্থূল দেহটাকে ঘষিয়া মাজিয়া ঝকঝকে করিবার চেষ্টায় হয়রান হয়। গালে রংটং দেয় নাকি বিষ্ণুপ্রিয়া?
বিষ্ণুপ্রিয়া বলিল, বস।
শ্যামা মেঝেতেই বসিয়া বলিল–কবে ফিরলেন দিদি? দিব্যি সেরেছে শরীর, রাজরানীর মতো রূপ করে এসেছেন, রং যেন আপনার দিদি ফেটে পড়ছে। … অসুখ শরীর নিয়ে হাওয়া বদলাতে গেলেন, আমরা এদিকে ভেবে মরি করে দিদি আসবেন, খবর পেয়ে ছুটে এসেছি।
বিষ্ণুপ্রিয়া হাই তুলিল, উদাস ব্যথিত হাসির সঙ্গে বলিল, এসেই আবার গরমে শরীরটা কেমন কেমন করছে, উঠতে বসতে বল পাই নে, বেশ ছিলাম সেখানে, খুকি তো কিছুতে আসবে না, কিন্তু ইস্কুলটিস্কুল সব খুলে গেল, কত আর কামাই করবে, তাই সকলকে নিয়ে চলেই এলাম।