যাচ্ছি যাচ্ছি, অমৃত বলে, এখুনি যাচ্ছি।
বীণা, হালিমকে বল গাড়ি বার করুক—এই দণ্ডে। খেতে বসে থাকলে বলবি পৌঁছে দিয়ে এসে খাবে। যদি না ওঠে, কাল থেকে বরখাস্ত। যাও না তুমি? দশ বছরে মুটিয়েছ বেলুনের মতো, একটা দিন একটু খাট?
যাচ্ছি, যাচ্ছি, এখুনি যাচ্ছি, বলে অমৃত।
হালিম খেতে বসে নি। তার যৌবনান্তের দিনগুলিতেও অনেক সমস্যা। আজ সে অনেক ঘুরেছে গাড়ি নিয়ে এত পেট্রোল বাবু কোথা থেকে যোগাড় করেন তা মাথায় ঢেকে না। বড় বড় লোকের সঙ্গে কারবার বাবুর, বাবুর কথাই বোধহয় আলাদা। অন্যদিন হয়তো রাগ করত। হালিম এত খাটুনির পর আবার এখন গাড়ি বার করবার হুকুম শুনলে, আজ সে কথা কয় না, অমৃতকে নিয়ে অসম্ভব স্পিডে গাড়ি চালিয়ে দেয়।
বাড়িতে বীণা তখন বলছে ব্যাকুলভাবে, মাগো, ওমা, কি হল তোমার? কেন এমন করছ? ওমা, মা–
ডাক্তার বার বার বলেছিল, সাবধান সাবধান। এ কোন মরীচিকার লোভে মা সে কথা ভুলে গেল। নিজের মরণ ডেকে আনবার মায়ের অদ্ভুত পাগলামির কথাই বীণা ভাবে ভাইবোনের সঙ্গে মায়ের মৃতদেহ আগলে বাপের প্রতীক্ষায় বসে থেকে। খাওয়াদাওয়ার প্রতিটি খুঁটিনাটি বিষয়ে এমন নিখুঁত সতর্কতা, মনে এত উদ্বেগ অশান্তি ক্ষোভ জমা করবার কি দরকার ছিল? এত পেয়েও সাধ মিটল না, যশ মান প্রতিপত্তির উগ্র কামনায় পুড়তে পুড়তে মরতে হল শেষে? ক্ৰমে ক্ৰমে যেন পাগল হয়ে উঠেছিল মা তার বাবাকে বড় একজন নেতা করার জন্য। এতই কি প্রচণ্ড নেতৃত্বের মোহ মানুষের যে বাবার জীবনটা তার ভরে ওঠে আত্মগ্লানি আর হতাশায় তবু তিনি থামতে পারেন। না, মাকে তার জীবনটা দিতে হয়। মা যেন তার আত্মহত্যা করেছে মনে হয় বীণার। নিঃশব্দ অঞর ধারা গড়িয়ে পড়তে থাকে বীণার গাল বেয়ে, ভাইবোনদের মতো সে চেঁচিয়ে কাঁদতে পারে না।
এদিকে গাড়ির গতির মতোই দ্রুত হয়ে ওঠে অমৃতের চিন্তার গতি। তাড়াতাড়ি মনে মনে সে আউড়ে নিতে থাকে ওখানে গিয়ে কি বলবে আর কি করবে, কোন কৌশলে কাজ হবে বেশি। অনেক দিন পরে হঠাৎ আজ যেন তার আত্মবিশ্বাস সজীব হয়ে উঠেছে মনে হয়, বেশ খানিকটা সে উত্তেজনা বোধ করে। অরুণা ঠিক কথাই বলেছে এসব সুযোগকে কাজে লাগিয়েই মানুষ জনসাধারণের মনে আসন পাতে, নেতা হয়। নানা সম্ভাবনা উঁকি দিয়ে যেতে থাকে অমৃতের মনে। একটা চিন্তা তাকে বিশেষভাবে উত্তেজিত করে তোলে, লোভ ও ভয়ের আলোড়ন তুলে দেয়। একটা কাজ সে করতে পারে, অতি চমকপ্রদ নাটকীয় একটা কাজ, সাধারণের মনকে যে ধরনের ব্যাপার প্রবলভাবে নাড়া দেয়। আজকের ঘটনা নিয়ে সে আন্দোলন করবে, একথা সে জানাবে। কিন্তু আরো সে এগিয়ে যেতে পারে। সে ঘোষণা করতে পারে যে গুলি চালানোর প্রতিবাদ এবং ওদের দাবির সমর্থনে এখন এই মুহূর্তে সে ওদের সঙ্গে যোগ দিল–তারপর ওদের মধ্যে গিয়ে। পথে বসে পড়তে পারে। পুলিশ গ্রেপ্তার করতে পারে তাকে। তাহলে তো আরো ভালো হয়।
চারিদিকে সাড়া পড়ে যাবে তাকে নিয়ে। কাগজে বড় বড় হরফে তার নাম বেরোবে…
বেরোবে কি? এই বিষয়েই মস্ত খটকা আছে অমৃতের মনে! নিজে নিজে সে এতখানি এগিয়ে গেলে বড়রা চটবেন সন্দেহ নেই। সে আন্দোলন করবে, ওদের হয়ে লড়বে, এইটুকু ঘোষণা করার জন্যই চটবে। ওরা চটলে কোনো বড় কাগজে তার নাম বেরোবে না। সে নিজে কোনো বিবৃতি দিলে তাও ছাপা হবে না। তারপর, সে যদি একেবারে রাজপথে গিয়ে বসে পড়ে ওদের মধ্যে ওদের সঙ্গে যোগ দিয়ে, রাগে হয়তো চোখে অন্ধকার দেখবেন চাইরা। আজকের ঘটনাকে তারা কিভাবে নেবেন, কিভাবে নিতে বাধ্য হবেন, এখন সঠিক অনুমান করে বলা যায় না। কিন্তু বড়দের মনোভাবের খানিকটা ইঙ্গিত আজকেই অমৃত পেয়েছে। এঁরা যতটা সম্ভব উদাসীন থাকতে চান, ঘটনাটিকে বেশি গুরুত্ব দিতে চান না। এই দলাদলির দিনে কোনো একটি বিশেষ দলের বাহাদুরি নেবার চেষ্টা বলে হয়তো ব্যাপারটা উড়িয়ে দেবেন। তাহলেই বিপদ অমৃতের। হয়তো তাকে দল থেকে রিজাইন দিতে হবে। নয়তো আজকের প্রকাশ্য ঘোষণা হজম করে ফেলে সরে দাঁড়িয়ে তলিয়ে যেতে হবে তলে।
কিন্তু কথাটা হল কি অমৃত হিসাব কষে যায় প্রাণপণে মাথা ঠাণ্ডা রাখবার চেষ্টা করে সে বিপদ নয় ঘটল, নেতারা নয় বর্জন করলেন তাকে, অন্যদিকে লাভ হবে নাকি কিছুই? হৈচৈ কি হবে না তাকে নিয়ে? অন্য দলে গিয়ে কি করতে পারবে না কিছু? এতকাল নেতাদের মুখ চেয়ে থেকে তো কিছু হল না, সরে গিয়ে অন্য চেষ্টা করে দেখলে ক্ষতি কি? কিন্তু সে সুযোগ যদি না পায়? যদি ফসকে যায় তার আজকের রাজনৈতিক স্ট্রাটেজি? তখন এদিকও যাবে, ওদিকও যাবে।
নরম ঘোষণাটা জানিয়ে বাড়ি ফিরে গেলে পরিস্থিতি যাই দাঁড়াক সে সামলে নিতে পারবে। কিন্তু গরম ঘোষণা আর চরম কাজটার মতো ফল তাতে হবে না–ওতে একরাত্রেই হয়তো সে বিখ্যাত ও জনপ্রিয় হয়ে যেতে পারে। কি করবে ঠিক করে উঠতে পারে না অমৃত। অরুণা কাছে নেই বলে বড় তার আফসোস হয়। অরুণার সঙ্গে একটু পরামর্শ করতে পেলে একটা সিদ্ধান্ত করে ফেলা যেত!
পাশের রাস্তা দিয়ে মোড়ের কাছাকাছি এসে অমৃতের গাড়ি থামে। ভিড় এখন বিশেষ নেই। অমৃত গাড়ি থেকে নেমে চলতে আরম্ভ করেছে, বোতাম খোলা কোট গায়ে লম্বা একটি যুবক এগিয়ে এসে তার সামনে দাঁড়ায়।
অমৃতবাবু, একটা কথা আছে।
আপনাকে তো–?
আমায় চিনবেন না। আপনার স্ত্রী হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েছেন, আপনি এখুনি বাড়ি ফিরে যান। আপনার বাড়ি থেকে টেলিফোনে খবর পেয়ে সুব্রত এসেছিল–আপনার মেয়ে টেলিফোন করেছিলেন। আপনাকে জানাতে বলে সুব্রত আপনাদের বাড়ি চলে গেছে।