কাল আমার ভাগ দিও।
নোটের তাড়াটা নিয়ে পাঞ্জাবি উঁচু করে ভেতরের উলের জামাটার পকেটে রেখে রাখাল হাসে, কাহিল অবস্থা বুঝি? কোথায় টানলে আমায় ফঁকি দিয়ে, এ্যাদ্দিনের পেয়ার আমি?
আর এক মুহূর্ত এ লোকটার সঙ্গে থাকলে সে সোজাসুজি হার্টফেল করে মরে যাবে, এই রকম একটা যন্ত্ৰণা হওয়ায় অক্ষয় মুখ ফিরিয়ে হাঁটতে আরম্ভ করে জোরে জোরে। তেরাস্তার মোড়টা পেরিয়ে আপিসের পথ ধরে চলতে চলতে তালা লাগানো গেটটার সামনে থামে। ওরা কি করছে। একবার দেখতে হবে।
দেখতে যদি হয়, তেতলার ব্যালকনিতে উঠে একটা অংশকে মাত্র দেখবে দূর থেকে? রাস্তা ধরে ওদের মধ্যে এগিয়ে গিয়ে ওরা কি করছে দেখতে বাধা কি? মনমোহনের সঙ্গেও হয়তো দেখা হয়ে যেতে পারে।
অথবা বাড়ি যাবে?
এখন শান্ত হয়ে গেছে হৃদয় মন! প্রতিটি ছোট বড় কাজে কি করা উচিত আর কি করা উচিত নয় চিন্তার উদ্ভ্রান্ত জটিলতায় পাক খেতে খেতে প্রাণান্ত হওয়ার বদলে এমন সহজ হয়ে গেছে। সাধারণ স্বাভাবিক বাস্তব সিদ্ধান্তে আসা। ওখানে গিয়ে ওদের মাঝখানে বসবে না বাড়ি যাবে প্রশ্ন এই। এর জবাবটাও সহজ। এখন ওখানে গিয়ে হাঙ্গামা বাড়াবার কোনো দরকার নেই তার, তাতে কারো উপকার হবে না, তার নিজের খেয়াল তৃপ্ত করা ছাড়া। বাড়ি যাওয়াও তার বিশেষ দরকার। সুতরাং বাড়িই সে যাবে।
তবে ওরা কি করছে, কি অবস্থায় আছে, একবার না দেখে গেলে তার চলবে না। গায়ের আলোয়ানটাও দিয়ে যেতে হবে। বাড়ি পৌঁছানো পর্যন্ত শীতে একটু কষ্ট হবে তার, কিন্তু বাড়িতে বাকি রাত তার কাটবে লেপের নিচে। ওরা খোলা আকাশের নিচে পথে কাটিয়ে দেবে রাতটা। আলোয়ানটাতে যদি একজনেরও শীতের একটু লাঘব হয়।
০৩. অমৃত মজুমদার তার বালীগঞ্জের বাড়িতে
অমৃত মজুমদার তার বালীগঞ্জের বাড়িতে ফিরে আসে রাত প্রায় দশটার সময়। বিষণ্ণ, হতাশ, গম্ভীর, পরিশ্রান্ত এবং দিশেহারা অমৃত মজুমদার। ছাত্রদের বসন্ত রায়ের বাণী শোনাবার জন্য পুলিশ-লরিতে ওঠবার সময় তার রীতিমতো কষ্ট হয়েছিল, কিন্তু নামবার সময় কি করে যেন ব্যথা লেগেছিল বাঁ দিকের কুঁচকিতে। বিশেষ কিছু নয় তবু ব্যথা তো। বা হাঁটুর বাতের ব্যথাটাও আছে খানিক খানিক। এসব জিমন্যাস্টিক কি পোষায় তার? কি যেন হয়েছে দেশে। এতকাল রাজনীতি করে এসেও আজ যেন তার বাঁধা লেগে যাচ্ছে, ব্যাপারটা বুঝেই উঠতে পারছে না হঠাৎ কোন দিকে গতি নিচ্ছে রাজনীতি। কোনো হলে বা পার্কে মিটিং কর, বক্তৃতা করবে। সংগ্রামের আহ্বান এলে তখন সগ্রাম করবে। মোটরে গিয়ে মঞ্চে উঠে যা করার করা যায় সে অবস্থায়। তা নয়, রাস্তায় ওরা এমন কাণ্ড বাধিয়ে বসে আছে যে, লরিতে উঠে দাঁড়িয়ে কথা বলতে হয়।
সে কথা শোনে না পর্যন্ত কেউ।
কি হল? সাগ্রহে জিজ্ঞেস করে মিসেস অরুণা মজুমদার, বলবার সুযোগ দিয়েছিল তো তোমাকে?
সব বৃত্তান্ত শুনে অরুণা তার রোগা করা মোটা দেহটি সোফায় এলিয়ে দিয়ে গভীর হতাশার সঙ্গে বলে, তুমি একটা পাগল, তুমি একটা ছাগল। তুমি কোনোদিন কিছু করতে পারবে না।
আমি কি করব? বসন্ত বাবু গেলেন না–
অরুণা ফোঁস করে ওঠে মনের জ্বালায়, বসন্তবাবু যে গেলেন না, সেটা যে তোমার কত বড় সুযোগ একবার খেয়ালও হল না তোমার? একবার মনেও হল না এই সুযোগে একটু চেষ্টা করলে এক রাত্রে তুমি নেতা হয়ে যেতে পার? একেবারে ফাকা ফিল্ড পেলে, কেউ তোমার কম্পিটিটর নেই, আর তুমি কিছু না করেই চলে এলে? তুমি সত্যি পাগল। সত্যি তুমি ছাগল। তোমাকে দিয়ে কিছু হবে না, কোনোদিন কিছু হবে না।
আমার কি করার ছিল?
আমি বলে দেব তোমার কি করার ছিল? কুঁসতে থাকে অরুণা ক্ষোভে দুঃখে, তুমি না দশ বছর পলিটিকস করছ? তুমি না সব জান সব বোঝ, অন্যে তোমার বুদ্ধি ভাঙিয়ে খায়? একবার উঠতে পারলে সারা দেশটাকে মুখের কথায় ওঠাতে বসাতে পার? আমার কাছে যত তোমার লম্বা চওড়া কথা, বন গায়ে শ্যাল রাজা। সবাই ওঁকে দাবিয়ে রাখে তাই উনি উঠতে পারলেন না, নামকরাদের তাবেদার হয়ে রইলেন। নিজের বুদ্ধি নেই ক্ষমতা নেই, অন্যের দোষ।
অমৃতের ফাপর-ফাপর লাগে, দশ বছরের বিফলতা বাতাসকে যেন ভারি করে দিয়েছে মনে হয়। কতভাবে কত চেষ্টা করল, কত চাল কত কৌশল খাটাল, মরিয়া হয়ে কত আশায় জেলে গেল, কিন্তু না হল নাম, না জুটল প্রভাব প্রতিপত্তি, বড় নেতা হওয়ার সৌভাগ্যও হল না এতদিনে। পাণ্ডাদের সঙ্গে মিলতে মিশতে পায়, সাধারণ বৈঠকে যোগ দিয়ে কথা বলতে পায়, সভায় মঞ্চে দাঁড়িয়ে দু-চার মিনিট বলতেও পায় তেমন সভা হলে বেশিক্ষণ। পরদিন খবরের কাগজ কেনে অনেকগুলি, সাগ্রহে সভার বিবরণ পাঠ করে। নিজের নাম খুঁজে পায় না কোথাও। যদি বা পায়, সে শুধু আরো নামের সঙ্গে উল্লেখ মাত্র।
অরুণার সঙ্গে তর্ক বৃথা। কিন্তু কিছু তাকে বলতেই হবে, না বলে উপায় নাই।
কথাটা তুমি বুঝছ না, অমৃত বলে কৈফিয়ত দেওয়ার সুরে, পাণ্ডারা যা ঠিক করলেন তার বিরুদ্ধে কি যাওয়া যায়? আমার নিজের কিছু করতে যাওয়া মানেই ওঁদের বিরোধিতা করা। এঁরা চটে যাবেন না তাতে? আমাকেই যে পাঠালেন বাণী দিয়ে, সেও তো একটা বড় সম্মান। কত বিশ্বাস করেন বল তো আমাকে। এত বড় একটা দায়িত্ব।
এরকম দায়িত্ব পালনের অনুগত ভক্ত না থাকলে কি পাণ্ডাগিরি চলে?
বীণার এই ঘরে ঢাকার মন্তব্য আরো কাহিল করে দেয় অমৃতকে। মায়ের মতোই হয়ে উঠেছে মেয়েটা। স্বামী পায় নি এখনো, বাপের ওপরেই কথার ঝাল ঝাড়ে।