প্রথমে যাকে প্রেসিডেন্ট করা হইয়াছিল হঠাৎ কয়েক ঘণ্টার নোটিশে তিনি একেবারে শহর ছাড়িয়া পলাইয়া যাওয়ায় স্যার কে. এল-কে প্রেসিডেন্ট করা হইয়াছে। সরসী ছাড়া আর কেউ তাকে এতটুকু সভায় আরেকজনের বদলিতে সভাপতিত্ব করিতে রাজি করাইতে পারি কিনা সন্দেহ।
সরসীই সভাপতিকে অভ্যর্থনা জানাইল। গাম্ভীর্য ও সহৃদয়তাব্যঞ্জক একটা অদ্ভুত মুখভঙ্গি করিয়া স্যার কে. এল এতক্ষণ যেখানে বসিয়া ছিলেন, একবার উঠিয়া দাঁড়াইয়া আবার সেইখানেই বসিয়া পড়িলেন। তারপর সরসী বক্তা ও বক্তৃতার বিষয়বস্তু সম্পর্কে পরিচয়মূলক কয়েকটি কথা বলিয়া নিজেও বসিয়া পড়িল।
রাজকুমার একদৃষ্টিতে এতক্ষণ সরসীর দিকে চাহিয়া ছিল, শুধু তার এই বসিবার ভঙ্গিটি দেখিবার জন্য। সরসীর ওঠাবসা চলাফেরার মধ্যে কি যেন একটা আকৰ্ষণ আছে, কেবলই তার চাহিয়া দেখিতে ইচ্ছা হয়। সরসীর আকর্ষণ তার কাছে খুব বেশি জোরালো নয়, কিন্তু সরসীর প্রত্যেকটি সর্বাঙ্গীণ অঙ্গ সঞ্চালন মৃদু একটা উত্তেজনা জাগাইয়া তাকে মুগ্ধ করিয়া দেয়।
উঠবেন না?
অন্যমনস্ক হওয়ার জন্য লজ্জিতভাবে রাজকুমার বক্তৃতা দিতে উঠিয়া দাঁড়াইল। সম্প্রতি সে মাস চারেক মাদ্রাজে কাটাইয়া আসিয়াছে, আজ তাকে মাদ্রাজের নারীজাতির সাধারণ অবস্থা ও প্রগতি সম্বন্ধে বক্তৃতা দিতে হইবে। একবার রাজকুমার মালতীর দিকে চাহিল। তাকে সচেতন করিয়া দিয়া মালতী ঘাড়ের পিছনটা খুঁটিতে খুঁটিতে দুষ্টামির হাসি মুখে ফুটাইয়া তুলিয়াছিল, এখনো সে হাসি তেমনি স্পষ্ট হইয়া আছে। মালতীর এই হাসি দেখিয়া হঠাৎ সরসীর উপর রাজকুমারের বড়ই রাগ হইয়া গেল। চার মাস একটা দেশে থাকিয়াই সে দেশের মেয়েদের সম্বন্ধে বক্তৃতা দেওয়ার মতো জ্ঞান একজন সঞ্চয় করিয়া আসিতে পারে, এমন কথা সরসীর মনে হইল কেমন করিয়া? মাথার কি ঠিক নাই মেয়েটার? কি সে বলিবে এখন এতগুলি লোকের সামনে!
কি বলিবে আগে হইতেই কিছু কিছু সে ঠিক করিয়া রাখিয়াছিল, কিন্তু মনের মধ্যে সব এমনভাবে এখন জড়াইয়া গিয়াছে যে কি বলিয়া আরম্ভ করিবে ভাবিয়া পাইল না। তিনবার বক্তৃতা শুরু করিয়া তিনবার থামিয়া গেল। কান তার গরম হইয়া উঠিল। লজ্জায় নয়, আতঙ্কে। শেষ পর্যন্ত কিছুই যদি বলিতে না পারে, এমনিভাবে তোলার মতো দু-চারটি শব্দ উচ্চারণ করিয়া যদি তাকে বসিয়া পড়িতে হয়।
অবরুদ্ধ উত্তেজনায় সভা থমথম করিতেছে, একটা অঘটন ঘটিবার সম্ভাবনা দেখা দিয়াছে, তারই প্রত্যাশার উত্তেজনা। মরিয়া হইয়া মনে মনে রাজকুমার বলিতে থাকে, একটা কিছু করা দরকার, দু-এক সেকেত্রে মধ্যে তার কিছু করা দরকার, শুধু ওইটুকু সময় হয়তো তার এখনো আছে। বক্তব্য? নাইবা রহিল বক্তব্য তার বক্তৃতার? বড় বড় কথা নাইবা সে বলিতে পারি? যা মনে আসে বলিয়া যাক, অন্তত বক্তৃতা তো দেওয়া হইবে। চুপ করিয়া এভাবে দাঁড়াইয়া থাকার চেয়ে সে অনেক ভালো।
একবার সে চাহিল রিণি মালতী সরসীর দিকে, তারপর বলিতে আরম্ভ করিল মাদ্রাজের মেয়েদের সম্বন্ধে। কি সে বলিবে মাদ্রাজের মেয়েদের সম্বন্ধে? যে চিরন্তন রহস্য যুগে যুগে দেশে দেশে নারীজাতিকে দুর্বোধ্য করিয়া রাখিয়াছে, মাদ্রাজের মেয়েরা তো তার কাছে সে রহস্যের ঘোমটা খুলিয়া তাদের জানিবার বুঝিবার সুযোগ তাকে দেয় নাই। সুতরাং সাধারণভাবে দু-চারটি কথা বলাই ভালো। গরম কান ঠাণ্ডা হয়, কথার জড়তা কাটিয়া যায়, মৃদু মৃদু রহস্যের সুরে কখনো গম্ভীর ও কখনো হাসিমুখে রাজকুমার বলিয়া যায়। মাঝে মাঝে তার মনে হইতে থাকে বটে যে সে। আবোল তাবোল বকিতেছে, কিন্তু নারীজাতি সম্বন্ধে তার জ্ঞানের পরিচয় পাইয়া সভার মেয়েরা একেবারে অভিভূত হইয়া যায়।
রাজকুমার আসন গ্রহণ করিলে শ্যামল উঠিয়া দাঁড়াইল। রাজকুমারের চেয়ে বয়সে দু-এক বছরের ছোট হইলেও লম্বা চওড়া চেহারা আর মুখের ভারিকি গড়নের জন্য তাকেই বড় দেখায়। এতক্ষণ সে মালতীর পাশে মুখ ভার করিয়া বসিয়া ছিল। তীব্র দৃষ্টিতে রাজকুমারের মুখের দিকে চাহিয়া বক্তৃতা শুনিতে শুনিতে মাঝে মাঝে নিজের মনে বিড়বিড় করিয়া মন্তব্য করিতেছিল : পাগলের মতো কি যে বকে লোকটা! মাথা খারাপ নাকি? যত সব চালবাজি!–
মালতী ছাড়া আর কেউ মন্তব্যগুলি শুনিতে পাইতেছিল কিনা বলা যায় না, একটা অত্যধিক কড়া কথা কানে যাওয়ায় মালতী একবার শুধু বলিয়াছিল : কি বললেন?
আপনাকে বলি নি। রাজুদা কি রকম আবোল তাবোল বকছেন, শুনছেন তো? দাঁড়ান, ওঁর বাহাদুরি ভেঙে দিচ্ছি। মেয়েদের ধোঁকা দিয়ে।
কি করবেন?
দেখুন না কি করি।
ছোটছেলের স্বপ্ন কাম্য খেলনা পাওয়ার মতো রাজকুমারকে জব্দ করার কি যেন একটা সুযোগ পাইয়া সে সযত্নে পুষিয়া রাখিতেছে, ফাঁক করিতে চায় না, ভাগ দিতে চায় না।
সে উঠিয়া দাঁড়াইতে তার উদ্দেশ্য কতকটা আন্দাজ করিয়া মালতী চাপা গলায় বলিল, না না থাক, বসুন। তার পাঞ্জাবির প্রান্ত ধরিয়া আলগোছে একটু টানও সে দিল, কিন্তু শ্যামল বসিল না।
আপনি কিছু বলবেন শ্যামলবাবু? এদিকে আসুন।–সরসী বলিল।
এখান থেকেই বলি?
আচ্ছা বলুন।
অনেকগুলি চোখের, তার মধ্যে বেশির ভাগ মেয়েলি চোখ, প্রত্যাশাপূর্ণ দৃষ্টি মুখে আসিয়া পড়িয়াছে অনুভব করিয়া এক মুহুর্তের জন্য শ্যামলের উৎসাহ যেন উবিয়া গেল। এখন মালতী আরেকবার তার পাঞ্জাবির কোণ ধরিয়া একটু টানিলেই সে হয়তো বসিয়া পড়িত। অসহায়ের মতো এদিক-ওদিক চাহিতে চাহিতে তার চোখে পড়িয়া গেল, রাজকুমারের মুখে মৃদু অমায়িক হাসি ফুটিয়া আছে, ছোটছেলে বাহাদুরি করিতে গেলে স্নেহশীল উদার গুরুজন যেমন প্রশ্রয়ের হাসি হাসেন।