মালতী বলিল, হ্যাঁ, আমিই মালতী। চলুন রাজুদা, যাই। বড্ড দেরি হয়ে গেল।
এতক্ষণ রিণির মুখে মৃদু ও স্পষ্ট একটা বিরক্তির ভাবের উপর মাখানো ছিল সবিনয় ভদ্রতার প্রলেপ, এক মুহূর্তে সমস্ত মুছিয়া গিয়া মুখ তার অন্ধকার হইয়া গেল। এমনভাবে একবার সে ঢোক। গিলিল যেন কড়া কড়া কতগুলি অভদ্ৰ কথাই গিলিয়া ফেলিতেছে। মন চিরিয়া দেওয়ার মতো ধারালো দৃষ্টিতে কয়েক সেকেণ্ড মালতীকে দেখিয়া হঠাৎ সে মুখ ফিরাইল রাজকুমারের দিকে।
শুনে যাও, তোমার সঙ্গে একটা কথা আছে।
মালতী ততক্ষণে আগাইয়া গিয়াছে বাহিরের দরজার কাছে, সেখান হইতে সেও তাগিদ দিয়া বলিল, শিগগির আসুন রাজুদা। দাঁড়াবেন না, চলে আসুন।
সুতরাং রাজকুমারের বিপদের আর সীমা রহিল না। তরুণী দুটির দৃষ্টিবিনিময় দেখিয়া তার মনে হইতে লাগিল, এই বুঝি একটা খুনোথুনি ব্যাপার ঘটিয়া যায়। রাগে আর আত্মসংযমের চেষ্টায় রিণির সমস্ত শরীর থরথর করিয়া কাঁপিতেছে। মালতীর মুখখানা এখনো হাসি হাসি বটে, কিন্তু সে হাসি যেন লড়াই করার ধারালো অস্ত্র। চোখের পলকে চোখের সামনে দুটি ভদ্রঘরের শিক্ষিতা মেয়ে যে এমন একটা নাটক সৃষ্টি করিতে পারে, রাজকুমারের সে অভিজ্ঞতা ছিল না। আড়ালে আড়ালে ভূমিকার অভিনয়টা নিশ্চয় ঘটিয়া গিয়াছে, এ পর্যন্ত সে টেরও পায় নাই। যত আয়োজনই হইয়া থাক, আকাশে তো প্রথমে মেঘ দেখা দেয়, তারপর বিদ্যুৎ চমকানোর সঙ্কেত পাওয়া যায়, তারপর বজ্ৰপাত। এ যেন ঠিক বিনা মেঘে বজ্ৰপাত ঘটিয়া গেল।
কি করা যায় এখনঃ একজন তাকে ডাকিতেছে অন্দরে, একজন ডাকিতেছে বাহিরে। কারো ডাকে সাড়া দিবার উপায় নাই। নিজেকে যদি দুভাগ করিয়া ফেলা যায়, তবু দুজনকে খুশি করা। যাইবে না। এমন হাস্যকর অথচ এমন গুরুতর অবস্থায় কি মানুষ কখনো পড়ে? রাজকুমার বেশ বুঝিতে পারিতেছিল, দুজনের মধ্যে একটা সাময়িক ও কৃত্রিম আপস ঘটাইয়া দেওয়া সম্ভব হইবে না। তার কাছে ছেলেমানুষি মনে হইতেছে, কিন্তু এটা ওদের ছেলেমানুষি নয় যে সমস্ত ব্যাপারটাকে হাসিয়া উড়াইয়া দেওয়া চলিবে। তার কথার কোনো দাম এখন ওদের কাছে নাই। আর কিছুই তার কাছে এখন ওরা চায় না, শুধু চায় যে একজনের হুকুম মানিয়া আরেকজনের মাথা সে হেঁট করিয়া দিবে।
রিণি অধীর হইয়া বলিল, এস?
মালতী হাসিমুখে বলিল, আসুন?
তখন রাজকুমার সেইখানে স্থির হইয়া দাঁড়াইয়া মালতীকে বলিল, এদিকে এস তো একটু।
মালতী বলিল, আবার ওদিকে কেন? চলুন যাই।
কিন্তু মালতী কাছে আসিল। যুদ্ধক্ষেত্র হইতে পলাতক ভীরু ও কাপুরুষ সৈনিকের মতো। রাজকুমার তার পাশ কাটাইয়া পালাইয়া গেল বাহিরে! বাহির হইতে দরজার পিতলের কড়া দুটিতে বাঁধিয়া দিল পকেটের নস্যমাখা ময়লা রুমালটি। গেট পার হইয়া রাস্তায় পা দিয়া তার মনে হইতে লাগিল, মাথাধরাটা একেবারে সারিয়া গিয়াছে। একটু যেন কেবল ঘুরিতেছে মাথাটা, ছেলেবেলায় নাগরদোলায় অনেকক্ষণ পাক খাইয়া মাটিতে নামিয়া দাঁড়াইবার পর যেমন ঘুরিত।
রিণি আর মালতী যে তারপর কামড়াকামড়ি করে নাই, সেটা জানা গেল সন্ধ্যার পর সরসীর মিটিঙে গিয়া।
রাজকুমার বাড়িতেই ছিল। শ্যামল একেবারে স্যার কে. এল-এর গাড়ি লইয়া আসিয়া খবর দিল, সরসী ডাকিয়া পঠাইয়াছে, অবিলম্বে যাইতেই হইবে।
মালতীর কাছে আপনি যাবেন না শুনে সরসী একদম ক্ষেপে গেছে। শিগগির চলুন।
রাজকুমারের অচেনা এক ভদ্রলোকের প্রকাণ্ড বাড়িতে মিটিং বসি বসি করিতেছিল। জন ত্রিশেক মেয়ে পুরুষ উপস্থিত আছে। সকলে স্বেচ্ছায় আসিয়াছে কিনা সন্দেহ, খুন সম্ভব সরসী। সকলকে ঘাড় ধরিয়া টানিয়া আনিয়াছে। রিণি এবং মালতীও উপস্থিত আছে। কারো মুখে আঁচড় কামড়ের দাগ নাই। রাজকুমার এক ফাঁকে মালতীকে জিজ্ঞাসা করিল, তার পর কি হল?
মালতী হাসিয়া বলিল, কিসের পর? আমি চলে যাওয়ার পর? কি আর হবে? ঘণ্টাখানেক গল্প করে আমিও চলে এলাম। রাজকুমার বিশ্বাস করিল না। মাথা নাড়িয়া বলিল, উঁহু, মিছে কথা।
তখন মালতী তার দুষ্টামির হাসিকে সরল হাসিতে পরিণত করিয়া বলিল, সত্যি মিছে কথা। ওর সঙ্গে এক ঘণ্টা গল্প করতে হলে আমি দম আটকে মরে যেতাম না। সত্যি সত্যি কি হল। তারপর শুনবেন? চাকর পাশের দরজা দিয়ে গিয়ে রুমালটা খুলে দিল। রিণি বলল, যাচ্ছ নাকি? আমি বললাম, হা যাচ্ছি। বলে চলে এলাম। আপনার রুমালটা আমার কাছে আছে, ওটা আর ফেরত পাচ্ছেন না।
তা না পেলাম। কিন্তু রিণি শুধু যাচ্ছ নাকি বলেছিল, যাচ্ছ নাকি ভাই বলে নি?
হ্যাঁ, হ্যাঁ, ঠিক। ও বলল, যাচ্ছ নাকি ভাই, আর আমি বললাম, হা ভাই যাচ্ছি।
সরসী খুব সম্ভব এ বাড়ির মেয়েদের বুঝাইয়া সভায় আনিতে অন্দরে গিয়াছিল, লজ্জা সঙ্কোচে একান্ত বিপন্না আট-দশটি মেয়ে-বৌকে গরু তাড়ানোর মতো সভায় আনিয়া হাজির করিল। রাজকুমারকে দেখিয়াই অনুযোগ দিয়া বলিল, বেশ মানুষ তো? তোমার বক্তৃতার জন্য মিটিং, তুমি বলে বসলে আসতে পারবে না?
সরসীর রং একটু কালো, দেহের গড়নটি অপরূপ। অতি অপরূপ। কালো মেয়েরও যদি রূপ থাকে, তার মতো রূপসী মেয়ে সহজে চোখে পড়িবে না। সাধারণভাবে কাপড় পরার কোনো এক নতুন কায়দা সে আবিষ্কার করিয়াছে কিনা বলা যায় না, আবরণ যেন তার দেহশ্ৰীকে ঢাকা দেওয়ার বদলে ছন্দ দিয়াছে।
সমিতি গড়িতে আর মিটিং করিতে সরসী বড় ভালবাসে। ঘরে তার মন বসে না, সারাদিন এইসব ব্যাপার নিয়া ঘুরিয়া বেড়ায়। ঘুরিয়া বেড়ায়, কিন্তু কখনো ব্যস্ত হয় না। সব সময় তাকে ধীর স্থির শান্ত প্রকৃতির মেয়ে বলিয়া মনে হয়। এদিক দিয়া সে মালতীর ঠিক উল্টো। মালতী চঞ্চল কিন্তু অলস, তার চাঞ্চল্য নাচের মতো, ছোটাছুটি বা কাজের নামেই তার আতঙ্ক উপস্থিত হয়। সরসী একদিন পঞ্চাশটি জায়গায় কাজে যাইতে পারে অনায়াসে, কিন্তু চলে সে ধীরে ধীরে পা ফেলিয়া, আস্তে আস্তে উচ্চারণ করে কথা, শান্ত দৃষ্টিতে তাকায়, কখনো উত্তেজিত হয় না।