কেবল সে একা নয়, সকলেই এই রকম। অনেক পরিবারে পনের বছরের মেয়েরও বাপভাই ছাড়া কোনো পুরুষের সামনে যাওয়া বারণ। এমন একটি মেয়ে যদি কেবল চুপি চুপি দুটি কথা বলার জন্যও পাশের বাড়ির ছেলেটাকে ডাকে, ছেলেটা কি ভাবিবে? রিণি চুম্বন চাওয়ার খানিক আগে সে যা ভাবিয়াছিল।
এমন একটা বিকৃত আবেষ্টনীর মধ্যে তারা মানুষ হইয়াছে যে, অস্বাভাবিক মিথ্যা অসংযমকেই ভারা স্বাভাবিক সত্য বলিয়া জানিতে শিখিয়াছে। মানুষ কেবল পরের নয়, নিজেরও সংযমে বিশ্বাস করে না। অসংযমের চেয়ে সংযম যে মানুষের পক্ষে বেশি স্বাভাবিক, এ যেন কেউ কল্পনাও করতে পারে না।
হঠাৎ রিণির গান বন্ধ হইয়া যাওয়ায় রাজকুমার সচেতন হইয়া উঠিল যে, সিঁড়ির মাঝখানে সে অনেকক্ষণ দাঁড়াইয়া আছে। তাড়াতাড়ি সে নিচে নামিয়া গেল।
নিচে হলঘরের এক কোণে অবনীবাবুর মেয়ে মালতী বসিয়া ছিল। সামনে ছোট টেবিলটিতে একটি বই ও খাতা। খুব সম্ভব কলেজ হইতে ফিরিবার সময় স্যার কে. এল-এর বাড়িতে ঢুকিয়াছে। এখানে একা বসিয়া দুহাতের আটটি আঙুলে টেবিলের উপর টোকা দিয়া টুকটাক আওয়াজ তুলিবার কারণটা রাজকুমার ঠিক বুঝিতে পারিল না। আট আঙুলে টোকা দেওয়ার কারণ নয়, এখানে একা বসিয়া থাকিবার কারণ। মালতী বড় চঞ্চল। চাঞ্চল্যটা শুধু আঙুলে সীমাবদ্ধ রাখিয়া সে যে স্থির হইয়া বসিয়া আছে, এটা সত্যই আশ্চর্যের ব্যাপার।
রাজকুমারকে দেখিবামাত্র টোকা দেওয়া থামিয়া গেল। চোখে-মুখে তার যে দুষ্টামি ভরা চকিত হাসি খেলিয়া গেল, বনের হরিণী হাসিতে জানিলেও তার নকল করিতে পারি না। সোজাসুজি তাকানো বদলে মাথা একটু কাত করিয়া কোনাকুনি রাজকুমারের দিকে তাকাইয়া বলিল, এর মধ্যে তাড়িয়ে দিল?
তাড়িয়ে দিল মানে?
ও, তাড়িয়ে দেয় নি? আপনি নিজে থেকে চলে যাচ্ছেন? আমি ভাবলাম আপনাদের বুঝি ঝগড়া হয়েছে, আপনাকে তাড়িয়ে দিয়ে রিণি বিনিয়ে বিনিয়ে কাঁদছে।
কাঁদছে নাকি?
দিনরাত কাঁদে মেয়েটা, সময় অসময় নেই। আচ্ছা, অর্গান বাজিয়ে কাঁদে কেন বলুন তো? এ আবার কোন দেশী কান্না! আমি যদি কখনো কাঁদি, রিণির মতো আপনার জন্যেই কাঁদি, আমাকে আবার একটা অর্গান কিনতে হবে নাকি?
রাজকুমার মৃদু হাসিয়া বলিল, রিণিকে জিজ্ঞেস কোবরা অর্গান বাজিয়ে কাদে কেন। খুশি হয়ে তোমার একটা চোখ কানা করে দেবেন।
পুরোপুরি গম্ভীর হওয়া মালতীর পক্ষে এক রকম অসম্ভব ব্যাপার, যতটা পারে গাম্ভীর্যের ভান করিয়া সে বলিল, জিজ্ঞেস করি নি ভাবছেন বুঝি? ও যে আমাকে দুচোখে দেখতে পারে না, আমিও কখনো ওদের বাড়ি আসি না, সেটা তবে কি জন্যে?
ওদের বাড়ি আস না মানে? এই তো এসেছ সশরীরে।
আজকের কথা বাদ দিন। আজ না এসে উপায় ছিল না, কলেজ থেকে ফিরছি। দেখি আপনি সরাসরি এ বাড়িতে ঢুকে পড়লেন। ব্যাপারটা ভালো করে না জেনে আর কি তখন বাড়ি ফিরতে পারি, আপনিই বলুন?
রাজকুমার রাগ করিয়া বলিল, ব্যাপার আবার কিসের? শরীরটা ভালো নেই, আজ ওর পার্টিতে আসতে পারব না, তাই বলতে এসেছিলাম।
মালতী দীর্ঘনিশ্বাস ফেলার মতো সজোরে একটা নিশ্বাস ফেলিয়া বলিল, তা ঠিক। শরীর খারাপ বলে যে পার্টিতে আসতে পারবে না, সে নিজেই খারাপ শরীর নিয়ে খবরটা দিতে আসে বটে। বাড়িতে যখন একটার বেশি চাকর নেই।
অন্য কারও ছিল।
আমিও তো তাই বলছি।
দরকার ছিল মানে–
মানে বুঝিয়ে বলতে হবে না স্যার। এ তো অঙ্ক নয় যে আপনি বুঝিয়ে না দিলে মাথায় ঢুকবে না। তার চেয়ে বরং কাছে আসিয়া গলা নামাইয়া ফিসফিস করিয়া বলিল–সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে অতক্ষণ কি ভাবছিলেন তাই বলুন। বলুন না, কাউকে বলব না আমি, আপনার গা ছুঁয়ে প্ৰতিজ্ঞা করছি।
মালতী কখনো তাকে স্যার বলে না। রাজকুমার তাকে পড়ায় বটে রোজ, কিন্তু ঠিক গুরু-শিষ্যার সম্পর্ক তাদের নয়। তার কথা বলার ভঙ্গি রাজকুমারকে আরো বেশি বিব্রত করিয়া তুলিল। রিণির সঙ্গে সত্য সত্যই কিছু না ঘটিয়া থাকিলে হয়তো সে রাগ করিতে পারিত, যদিও মালতীর উপর রাগ করা বড় কঠিন। মালতী তামাশা করে, সব সময়ে সব বিষয়ে এরকম হালকা পরিহাসের ভঙ্গিতেই কথা বলে, কিন্তু কখনো খোঁচায় না। পরিচিত সকলেই যেন তার কাছে নতুন জামাই আর সে তার মুখরা শ্যালিকা। মনে যদি কারো খোঁচা লাগে তার কথায়, সেটা তার মনের দোষ, মালতীর নয়।
হঠাৎ রাজকুমারের একটা কথা মনে পড়িয়া গেল।–কি দরকারে এসেছি, দেখবে? বলিয়া ঘরের একপাশে টেলিফোনের কাছে আগাইয়া গিয়া রিসিভারটা তুলিয়া নিল। কাল সে কাজে যাইতে পারিবে না রাজেনকে এই খবরটা দিয়া আরো কতগুলি আজেবাজে কথা বলিয়া রিসিভারটা নামাইয়া রাখিল।
দেখলে?
মালতী এতক্ষণ তার দুষ্টামির হাসি মুখে ফুটাইয়া রাখিয়াছিল, চার-পাঁচবার মাথা হেলাইয়া সায় দিয়া বলিল, দেখলাম বৈকি, নিশ্চয় দেখলাম। অমন কত দেখছি রোজ! শ্যামল করে কি জানেন, যখন তখন আমাদের বাড়িতে এসে হাজির হয় আর আমাকে ডেকে বলে–একটা ফোন করব। অন্য সবাই রয়েছে বাড়িতে, তাছাড়া ফোন করার জন্য কারো অনুমতি চাওয়ারও ওর দরকার নেই, কিন্তু আমাকে ডেকে ওর বলা চাই। আমি বলি, বেশ তো, ফোন করুন। তার পর একথা সেকথা বলতে বলতে গল্প জমে যায়, বেচারির দরকারি ফোনটা আর করা হয় না।
কথার মাঝখানে রিণি ঘরে আসিয়াছিল। একবার বলিয়াছিল, মালতী নাকি? কিন্তু মালতী তার দিকে চাহিয়াও দ্যাখে নাই। কথা শেষ হইতে সে তাই আবার বলিল, এই যে মালতী!