তাই সে বিরক্ত হওয়ার ভান করিয়া জবাব দিল, গিরি দরজা খুলল, কে আবার খুলবে?
মনোরমা কতক্ষণ কি যেন ভাবিল। মুখের গাম্ভীর্য ক্রমেই তার কমিয়া যাইতেছিল।
একটা কথা তোমায় বলি ভাই, রাগ কোরো না কিন্তু। তোমার ভালোর জন্যই বলা। আমি কিছু ভেবে বলছি না কথাটা, শুধু তোমাকে সাবধান করে দিচ্ছি। জেনেশুনে যদি দরকার মতো তোমায় সাবধান করেই না দিলাম, আমি তবে তোমার কিসের দিদি? অত বেশি যখন তখন গিরিদের বাড়ি আর যেও না।
কেন?
আহা, কেমন ধারা মানুষ ওরা তা তো জান? গেঁয়ো অসভ্য মানুষ ওরা, কুলি মজুরদের মতো ছোট মন ওদের, সব কথার বিচ্ছিরি দিকটা আগে ওদের মনে আসে। বড় হলে ভাইৰােন যদি নির্জনে বসে গল্প করে, তাতেও ওরা ভয় পেয়ে যায়। বড়সড় একটা মেয়ে যখন বাড়িতে আছে, কি দরকার তোমার যখন তখন ওদের বাড়ি যাবার? বিপদে পড়ে যাবে একদিন।
ওইটুকু একটা মেয়ে–
মনোরমা বাধা দিয়া বলিল, ওইটুকু মেয়ে মানে? আজ মেয়ের বিয়ে দিলে ওর মা একবছর পরে নাতির মুখ দেখবার আশায় থাকবে। ওরা তো আর তোমাদের মতে মানুষ নয় রাজু ভাই যে ওইটুকু দেখায় বলেই ভাববে আজো মেয়ের ফ্ৰক পরে থাকার বয়েস আছে। যেমন ধর ও বাড়ির রিণি, গিরির চেয়ে বয়সেও বড় এমনিও বড় দেখায় ওকে। সেদিন রিণিকে একা নিয়ে তুমি বায়োস্কোপ দেখাতে গেলে, একদিন গিরিকে নিয়ে যাবার কথা বলে দেখ তো ওর বাপ-মা কি বলে?
মনোরমার মুখের গাম্ভীর্য একেবারেই উবিয়া গিয়াছে, তার সুন্দর মুখখানিতে থমথম করিতেছে। কথা বলার আবেগ।
তারপর ধর সরসী। ওর বাড়ন্ত গড়ন দেখলে আমারই ভয় করে, সে দিন তুমি ওর হাত ধরে টানছিলে—
তামাশা করছিলাম।
তামাশাই তো করছিলে। কিন্তু একদিন তামাশা করতে গিয়ে ওমনি ভাবে গিরির হাত ধরে টেনো দিকি কি কাটা হয়! সরসীর বাপ-মা হাসছিল, গিরির বাপ-মা তোমায় জ্যান্ত পুড়িয়ে মারবে। তুমি তো আর সামলে সুমলে চলতে জান না নিজেকে, তাই বলছিলাম, নাইবা বেশি মেলামেশা করলে ওদের সঙ্গে?
খোকাকে শোয়াইয়া দিয়া নিজেও মনোরমা কাত হইয়া তার পাশে শুইয়া পড়িল।
কালীকে আনতে যাবে না রাজু ভাই?
যাব।
ঘরে গিয়া রাজকুমার বিছানায় শুইয়া পড়িল। মাথাধরার কথাটা আবার সে ভুলিয়া গিয়াছে। শুইয়া শুইয়া চোখ বুজিয়া সে আকাশপাল ভাবিতে থাকে আর থাকিয়া থাকিয়া মনে হয়, তবে, তবে কি গিরি আর গিরির মার কোনো দোষ ছিল না, সে-ই বোকার মতো একটা অসঙ্গত কাজ করিয়া তার স্বাভাবিক ফল ভোগ করিয়াছে? মনোরমা পর্যন্ত জানে যে গিরির হাত ধরিয়া টানার অপরাধে তাকে জ্যান্ত পুড়াইয়া মারাটাই গিরির বাপ-মার পক্ষে স্বাভাবিক হইবে। তাই যদি হয়, এমনি সব রীতিনীতি চালচলনের মধ্যে এমনি সব মনের সাহচর্যে গিরি যদি বড় হইয়া থাকে আর দশটি মেয়ের মতো, তবে তো সে খাপছাড়া কিছুই করে নাই, ও অবস্থায় তার মতো আর দশটি মেয়ে যা করিত সেও তাই করিয়াছে। এবং মনোরমার কথা শুনিয়া তো মনে হয় ওরকম আর দশটি মেয়ের অভাব দেশে নাই।
বুঝিয়া চলিতে না পারিয়া সে-ই কি তবে অন্যায় করিয়াছে? কিন্তু রাজকুমারের মন সায় দিতে চায় না। ব্যাপারটা যদি সংসারের সাধারণ নিয়মের বহির্ভূত খাপছাড়া একটা দুর্ঘটনা নাও হয়, অসাধারণ কোনো কারণে ভুল করার বদলে আর দশটি মেয়ের মতো নিজের রুচিমাফিক সঙ্গত কাজই গিরি করিয়া থাকে, গিরির মার গালাগালিটাও যদি সংসারের সাধারণ চলতি ব্যাপারের পর্যায়ে গিয়া পড়ে তবে তো সমস্ত ব্যাপারটা হইয়া দাঁড়ায় আরো কদর্য! এমন বীভৎস মনের অবস্থা কেন হইবে মানুষের? এমন পারিপার্শ্বিকতাকে কেন মানুষ মানিয়া লইবে যার প্রভাবে মানুষের মন এতখানি বিকারগ্রস্ত আর কুৎসিত হইয়া যায়?
মাথাটা আবার ভার মনে হইতে লাগিল। সত্যই কি আজ তার মাথা ধরিবে, না, অনেক চিন্তা আর উত্তেজনার ফলে আজ মাথাটা এরকম করিতেছে? একবার স্যার কে. এল-এর বাড়ি গেলে হয় না, সে যে আজ তার পার্টিতে যাইতে পারিবে না এই কথাটা রিণিকে বলিয়া আসিতে? এবং একবার রিণির হাত ধরিয়া টানিয়া আসিতে?
রাজকুমারের মনে হইতে লাগিল, একবার রিণিদের বাড়ি গিয়া খেলার ছলে রিণির হাত ধরিয়া টানিয়া আর ব্লাউজের একটা বোতাম পরীক্ষা করিয়া সে যদি আজ প্রমাণ না করে যে ভদ্র মানুষ সব সময় সব কাজের কদর্য মনে করিবার জন্যই উদ্গ্রীব হইয়া থাকে না, তবে তার মাথাটা ধীরে ধীরে বোমায় পরিণত হইয়া ফাটিয়া যাইবে। তাড়াতাড়ি সে বিছানা ছাড়িয়া উঠিয়া পড়িল!
০২. রিণি চমৎকার গান গাহিতে পারে
রিণি চমৎকার গান গাহিতে পারে। অন্তত লোকে তাই বলে। গলাটি তার মৃদু ও মিহি, সুরগুলি তার কোমল ও করুণ, গান সে শিখিয়াছে নামকরা এক ওস্তাদের কাছে। ওস্তাদের বুদ্ধি ছিল তাই তিনি শিষ্যাকে কিছুমাত্র ওস্তাদি শিখাইবার চেষ্টা করেন নাই, শুধু শিখাইয়াছেন মোলায়েম সুর। কেউ কেউ অবশ্য বলে যে রিণি গান করে না, বিড়াল ছানার ছাড়া ছাড়া করুণ আওয়াজটাকেই একটানা উচ্চারণ করিয়া যায়, তবু অনেকের কাছেই রিণির গান ভালো লাগে। মনটা উদাস হইয়া যায় অনেকের, ঘুমের বাহন ছাড়াই স্বৰ্গত স্বপ্ন নামিয়া আসে অনেকের চোখে, লজ্জা ও বেদনার সঙ্গে অনেকের মনে হয় যে এত ঘষামাজার পরেও তো তারা মার্জিত জীবনযাত্রার পথে বিনা চেষ্টায় পিছলাইয়া চলিবার মতো মোলায়েম হইতে পারে নাই।
স্যার কে. এল-এর বাড়ির সদরের সুশ্রী দরজাটি পার হইয়া ভিতরে পা দেওয়ামাত্র টের পাওয়া যায়, বাহিরের রাস্তাটা কি নোংরা। কতবার রাজকুমার এ দরজা পার হইয়াছে। কিন্তু একবারও দরজাটি পার হওয়ার একমুহূর্ত আগে এই অভিজ্ঞতা তার মনে পড়ে না। স্যার কে. এল-এর বাড়ির ভিতরটা শুধু দামি ও সুশ্রী আসবাবে সুন্দরভাবে সাজানো নয়, সদর দরজার এপাশে এ বাড়ির বিস্ময়কর রূপ ও শ্রীর মহিমাটাই শুধু স্পষ্ট হইয়া নাই, কি যেন একটা ম্যাজিক ছড়ানো আছে চারিদিকে–পার্থক্য ও দূরত্বের ইঙ্গিতভরা এক অহঙ্কারী আবেষ্টনীর দুর্বোধ্য প্রভাবের ম্যাজিক।