স্যার কে. এল-এর বাড়িতেই রাজকুমারের বেশিরভাগ সময় কাটে–রিণির কাছে। রাজকুমার না থাকিলে রিণি অস্থির হইয়া ওঠে, কাঁদিতে কাদিতে নিজের চুল ছেড়ে, রাগ করিয়া। আলমারির কাচ, চীনামাটির বাসন ভাঙে, বইয়ের পাতা ছিড়িয়া ফেলে, ধরিতে গেলে মানুষকে কামড়াইয়া দেয়, জামাকাপড় খুলিয়া ফেলিয়া নগ্ন দেহে রাজকুমারের খোজে বাহির হইয়া যাইতে চায় পথে। রাজকুমারকে দেখিলেই সে শান্ত হইয়া যায়, আশ্চর্যরকম শান্ত হইয়া যায়। প্রায় স্বাভাবিক সুস্থ মানুষের মতো কথা বলে ও শোনে, চলাফেরা করে, খাবার খায়, ঘুমায়। একটু তফাত। হইতে লক্ষ করিলে অজানা মানুষের তখন বুঝিবার উপায় থাকে না তার কিছু হইয়াছে। কোনো কোনো মুহুর্তে রাজকুমারের পর্যন্ত মনে হয় যে রিণি বুঝি সারিয়া উঠিয়াছে, একটা চমক দেওয়া উল্লাস জাগিতে না জাগিতে লয় পাইয়া যায়। রিণির চোখ রাজকুমার যত কাছেই থাক, যতই সুস্থ ও শান্ত মনে হোক রিণিকে, দুটি চোখের চাহনি রিণির ক্ষণিকের জন্যও স্বাভাবিক হয় না।
প্রথম দিকে রাত্রে রিণিকে ঘুম পাড়াইয়া রাজকুমার নিজের ঘরে ফিরিয়া যাইত, কিন্তু দেখা গেল এ ব্যবস্থা বজায় রাখা অসম্ভব। হঠাৎ ঘুম ভাঙিয়া রিণি হৈচৈ সৃষ্টি করিয়া দেয়, কেউ তাকে সামলাইতে পারে না, শেষ পর্যন্ত রাজকুমারকে ডাকিয়া আনিতে হয়। রাত্রে রাজকুমারকে তাই এ বাড়িতে শোয়ার ব্যবস্থা করিতে হইয়াছে।
স্যার কে. এল কিছু বলেন নাই। রাজকুমার নিজেই তার কাছে প্রস্তাব করিয়াছিল।
আপনার আপত্তি নেই তো?
না।
লোকে নানা কথা বলবে।
বলুক।
রাত্রে মাথার কাছে বিছানায় বসিয়া শিশুর মতো গায়ে মাথায় হাত বুলাইয়া রিণিকে সে ঘুম পাড়াইল, তারপর নিজের ঘরে যাওয়ার আগে কথাটা আরো পরিষ্কার করিয়া নেওয়ার জন্য আরেকবার গেল স্যার কে. এল-এর ঘরে।
আপনি যদি ভালো মনে করেন, রিণিকে আমি বিয়ে করতে রাজি আছি।
কেন?
আপনি তো বুঝতে পারছেন, প্রায় স্বামী-স্ত্রীর মতোই আমাদের দিনরাত একত্রে থাকতে হবে–কতকাল ঠিক নেই।
রাজু, স্ত্রী পাগল হলে স্বামী তাকে ত্যাগ করে।
তবু আপনার মনে যদি–
আমার মনে কিছু হবে না রাজু। শুধু মনে হবে তুমি রিণিকে সুস্থ করার জন্য নিজেকে উৎসর্গ করেছ। সেদিন বলি নি তোমাকে, রিণিকে আমি তোমায় দিয়ে দিয়েছি? তোমাকে ছাড়া ওর এক মুহূর্ত চলবে না, আমার পাগল মেয়ের জন্য তুমি সব ত্যাগ করবে আর আমি নীতির হিসাব করতে বসব? তোমাকে আমি বাঁধতে চাই না রাজু। আমি চাই যখন খুশি তোমার চলে যাবার পথ ভোলা থাকবে। তুমি ভিন্ন ঘরে বিছানা করেছ, দরকার হলে রিণির ঘরে গিয়ে শুয়ে থাক, আমাকে জিজ্ঞাসা করারও প্রয়োজন নেই। আমার মেয়েকে তুমি ভালো করে দাও, আমি আর কিছু চাই না, রাজু।
সরসীও এই কথাই বলিল রাজকুমারকে। বলিল যে রিণির সঙ্গে রাজকুমারের এই ঘনিষ্ঠতা তার কাছেও যখন এতটুকু দোষের মনে হইতেছে না, রাজকুমারেরও সঙ্কোচ বোধ করার কারণ নাই। জীবন তো খেলার জিনিস নয় মানুষের।