ধীরে ধীরে কথা বলিতে আরম্ভ করিয়া সরসী শেষের দিকে উত্তেজিত হইয়া উঠিয়াছে। আবেগ ও উত্তেজনা চিরদিন সরসীর চোখে-মুখে অভিনব রূপান্তর আনিয়া দেয় এবং এই রূপান্তর তার ঘটে এত কদাচিৎ যে, আগে কয়েকবার চোখে পড়িয়া থাকিলেও রাজকুমারের মনে হয় হঠাৎ সরসীকে ঘিরিয়া অপরিচয়ের রহস্য নামিয়া আসিয়াছে।
আমি তো বললাম তোমায়, আমি জানি রিণি আমার জন্য পাগল হয় নি।
তবে তুমি এমন করছ কেন?
সরসীর প্রশ্নে রাজকুমার আশ্চর্য হইয়া গেল।
কেমন করছি?
একেবারে যেন ভেঙে পড়েছ তুমি। মুখ দেখে টের পাওয়া যায় ভয়ানক একটা মানসিক যন্ত্রণা ভোগ করছ। সবাই বলাবলি করছে এই নিয়ে। তোমার কাছে এ দুর্বলতা আশা করি নি রাজু।
সত্যি কথা শুনবে সরসী? আমার মন ভেঙে গেছে।
কেন?
কেন তোমায় কি করে বুঝিয়ে বলব! আমি নিজেই ভালো করে বুঝতে পারি না। কেবল মনে হয় আমার জীবনের কোনো সম্ভাবনা নেই, সার্থকতা নেই, আমি একটা ফাঁকি দাঁড়িয়ে গেছি। চিরদিন যেন ভাঙাচোরা মানুষ ছিলাম মনে হয়, এখানে ওখানে সিমেন্ট করে বেঁধেৰ্ছেদে আস্ত মানুষের অভিনয় করছিলাম, এতদিনে ভেঙে পড়েছি। চব্বিশ ঘণ্টা নিজের কাছে লজ্জা বোধ করছি সরসী।
সরসী অস্কুটস্বরে কাতরভাবে বলে, আরেকটু স্পষ্ট করে বলতে পার না রাজু? আমি যে কিছুই বুঝতে পারলাম না। অন্যভাবে ঘুরিয়ে বল।
রাজকুমার অনেকক্ষণ ভাবে। তার চোখ দেখিয়া সরসীর মনে হয়, মনের অন্ধকারে সে নিজের পরিচয় খুঁজিয়া ফিরিতেছে। চোখে তার আলোর এত অভাব সরসী কোনোদিন দেখে নাই, এ যেন মুমূর্ষর চোখ। সরসী শিহরিয়া ওঠে। হাতের মুঠি সে সজোরে চাপিয়া ধরে ঠোঁটে, চোখ তার জলে ভরিয়া যায়। রাজকুমার কথা বলিতে আরম্ভ করিলে প্রথম দিকের কথাগুলি সে শুনিতে পায় না।
রাজকুমার বলে, ঘুরিয়ে বলেও বোঝাতে পারব না সরসী। যদি বলি, ভেতর থেকে জুড়িয়ে যেন ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছি, ঠিক বলা হবে না। যদি বলি, বহুকাল থেকে আমি যেন ধীরে ধীরে সুইসাইড করে আসছি, তাও ঠিক বলা হবে না। আমার এই কথাগুলি কি ভাবে নিতে হবে জান? গন্ধ বোঝাবার জন্য তোমায় যেন ফুল দেখাচ্ছি।
কি ভাব তুমি? মোটা কথায় তাই আমাকে বল।
কি ভাবি ভাবি যে আমি এমন সৃষ্টিছাড়া কেন। কারো সঙ্গে আমার বনে না, সহজ সম্পর্ক গড়ে উঠতে পারে না। অন্য সবাইকে দেখি, খুব যার সঙ্কীর্ণ জীবন, তারও কয়েকজনের সঙ্গে সাধারণ সহজ সম্পর্ক আছে, আত্মীয়তার বন্ধুত্বের, ঘৃণা বিদ্বেষের সম্পর্ক। কারো সঙ্গে আমার সে যোগাযোগ নেই। কি যেন বিকার আমার মধ্যে আছে সরসী, আর দশজন স্বাভাবিক মানুষ যে জগতে সুখে বিচরণ করে আমি সেখানে নিজের ঠাঁই খুঁজে নিতে পারি না। আমার যেন সব খাপছাড়া, উদ্ভট। নাড়ি দেখব বলে আমি গিরির সঙ্গে কেলেঙ্কারি করি, শুধু খেয়ালের বশে রিণি মুখ বাড়িয়ে দিলে আমার কাছে সেটা বিরাট এক সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়, সৌন্দর্যের বদলে মেয়েদের দেহে আমি খুঁজি আমার থিয়োরির সমর্থন। আমার যেন সব বাকা, সব জটিল। বুঝতে পার না সরসী তোমাদের সঙ্গেও আমার যোগাযোগটা কিরকম? তুমি কখনো আমার বিচার কর না, শুধু আমায় বুঝবার চেষ্টা কর, তোমার সঙ্গে তাই প্রাণ খুলে কথা বলি। শুধু ওইটুকু সম্পর্ক তোমার সঙ্গে আমার। আমার সঙ্গে শুধু আমার কথা তুমি বলবে, তোমার যেন আর কাজ নেই। তোমার সম্বন্ধে কিছু জানবার কৌতূহল কোনোদিন দেখেছ আমার? তোমার সুখ দুঃখের ভাগ নেবার আগ্রহ দেখেছ কখনো? আমার প্রয়োজনে আমার জন্য তুমি একদিন আশ্চর্য সাহস আর উদারতা দেখালে তাই জানতে পারলাম তোমার দেহ মন কত সুন্দর। কিন্তু কৃতজ্ঞতা কই আমার?
কৃতজ্ঞতা চাই নি রাজু।
তুমি না চাও, আমার তো স্বাভাবিক নিয়মে কৃতজ্ঞতা বোধ করা উচিত ছিল? ওটা যেন আমার প্রাপ্য বলে ধরে নিয়েছি। তাহলেই দ্যাখ, তুমি যে আমার কাছে এসেছ, সেটা শুধু বিনা বিচারে অসীম ধৈর্যের সঙ্গে আমাকে তোমার গ্রহণ করার চেষ্টার পথে, অন্তরঙ্গতার পথে নয়। অন্য কেউ হলে আপনা থেকে তোমাকে বোঝবার চেষ্টা করত, পরস্পরের জানাবোঝার চেষ্টায় সৃষ্টি হত সুন্দর স্বাভাবিক বন্ধুত্ব। আমার সেটা কোনোদিন খেয়াল পর্যন্ত হয় নি।
তুমি আমায় কখনো উপেক্ষা কর নি রাজু।
কেন করব? আয়নাকে কেউ উপেক্ষা করে না।
সরসী নতমুখে নিজের আঙুলের খেলা দেখিতে থাকে। আঁচলের প্রান্ত নয়, কোলের কাছে জড়ো করা কাপড়ের খানিকটা পাকাইয়া কখন সে যেন আঙুলে জড়াইতে আরম্ভ করিয়াছে।
রাগ করলে সরসী? স্পষ্ট করে বললাম বলে?
সরসী মুখ তুলিয়া একটু হাসিল রাগ করেছিলাম। তুমি জিজ্ঞেস করলে বলে আর রাগ নেই। রাগ করি আর নাই করি তুমি স্পষ্ট করেই বলযত স্পষ্ট করে পার। রাজকুমার বলে, তোমার কথা আর বলব না। এবার মালতীর কথা বলি। মালতীর সঙ্গে আমার কি সম্পর্ক দাঁড়িয়েছে জান? শ্ৰদ্ধাকে ভালবাসা মনে করার সম্পর্ক। সোজাসুজি ভালবাসলে হয়তো ওকে কাছে আসতে দিতাম না, ভুলেই থাকতাম মালতী বলে একটা মেয়ে এ জগতে আছে। কিন্তু ভিত্তিটা যখন ভুলের, দুদিন পরে ভুল ভেঙে যাবে যখন জানি, জটিল একটা সম্পর্ক সৃষ্টি হতে দিতে আমার বাকা মনের আপত্তি হবে কেন? তারপর ধর রিণি–
সরসী চেয়ারের পিছনে হেলান দিয়াছিল, সোজা হইয়া বসে। বোঝা যায় মালতীর চেয়ে রিণির কথা শুনতেই তার আগ্রহ বেশি।
রিণি যতদিন সুস্থ ছিল, আমার সঙ্গে বনত না। আমি কাছে গেলেই যেন কঠিন হয়ে যেত। পাগল হয়ে এখন রিণি সকলকে ত্যাগ করে আমায় আশ্রয় করেছে, আমি ছাড়া ওর যেন কেউ নেই। আগে ওকে আমার পছন্দ হত না, এখন ওর জন্য আমার মন কাঁদে। বিশ্বাস করতে পার সরসী? এমন সৃষ্টিছাড়া কথা শুনেছ কোনোদিন? সাধারণ রিণির সঙ্গে নয়, পাগল রিণির সঙ্গে আমার সম্পর্ক গড়ে উঠল।