স্যার কে. এল শান্ত কণ্ঠে বলেন, কই না, কিছুই তো বল নি তুমি?
বলেছি। রাজুদা আমার বেস্টফ্রেন্ড, তাই বলেছি। নিন্দে করে কিছু বলি নি। বলেছি বাবা?
না। বল নি।
নিশ্চিন্ত হইয়া রাজকুমারের পাশে বসিয়া রিণি গভীর নিশ্বাস ফেলিয়া, বিড়বিড় করিয়া আরো কত কি যে বলিতে লাগিল বোঝা গেল না। একটু অপেক্ষা করিয়া স্যার কে. এল চলিয়া গেলেন।
রাজকুমার বলিল, একটু শুয়ে থাকবে রিণি?
রিণি উদাসভাবে বলিল, তুমি বললে শুতে পারি।
তোমার শরীর ভালো নেই, শুয়েই থাক। আমি এখুনি ঘুরে আসছি।
তুমি আর আসবে না।
আসব, নিশ্চয় আসব।
বিনা দ্বিধায় রাজকুমার তাকে শিশুর মতো দুহাতে বুকে তুলিয়া বিছানায় লইয়া গিয়া। শোয়াইয়া দিল। তার অনেক দিনের লিপস্টিক ঘষা ঠোঁট আজ শুকনো রক্ত মাখা হইয়া আছে। সন্তৰ্পণে সেখানে চুম্বন করিয়া সে নীরবে বাহির হইয়া গেল।
নিজের ঘরে স্যার কে. এল টেবিলে মাথা রাখিয়া বসিয়া ছিলেন, টেবিলে তার মাথার একদিকে একটি আধখালি মদের বোতল অন্যদিকে শূন্য একটি গেলাস। রাজকুমারের সাড়া পাইয়া মুখ তুলিলেন।
নার্ভাস ব্রেক ডাউন? রাজকুমার জিজ্ঞাসা করিল।
স্যার কে. এল মাথা নাড়িলেন।–ইনস্যানিটি।
ডাক্তার কি বললেন?
এখন আর ওর বেশি কি বলবেন? সারতেও পারে, নাও সারতে পারে। ভালো রকম এগজামিনের পরে হয়তো জানা যাবে।
পরস্পরের মাথার পাশ দিয়া পিছনের দেয়ালে চোখ পাতিয়া দুজনে অনেকক্ষণ নীরবে মুখোমুখি বসিয়া রহিল।
তারপর স্যার কে. এল ধীরে ধীরে বলিলেন, আমার আলমারি খুলে বোতল নিয়ে কদিন নাকি খুব ড্রিঙ্ক করছিল। কিছু টের পাই নি। ডাক্তার সন্দেহ করছেন খুব ধীরে ধীরে ইনস্যানিটি আসছিল, অতিরিক্ত ড্রিঙ্ক করার ফলে দু-চার দিনের মধ্যে এটা হয়েছে। রিণি ড্রিঙ্ক করত নাকি জান?
কদাচিৎ কখনো একটু চুমুক দিয়ে থাকতে পারে, সে কিছু নয়।
স্যার কে. এল-এর মাথা নিচে নামিতে নামিতে প্রায় গেলাসে ঠেকিয়া গিয়াছিল তেমনিভাবেই তিনি জিজ্ঞাসা করিলেন, তোমার নামে রিণি যা বলেছিল রাজু?
সব কল্পনা।
তোমায় নিয়ে কেন?
তা জানি না।
আবার দুজনে নীরবে মুখখামুখি বসিয়া রহিল।
০৭. জীবন তো খেলার জিনিস নয় মানুষের
রিণির জন্য সকলের গভীর সহানুভূতি জাগিয়াছে। খবর শুনিয়া মালতী তো একেবারে কাঁদিয়াই ফেলিয়াছিল। রিণিকে কে পছন্দ করিত না এখন আর জানিবার উপায় নাই। একেবারে পাগল হইয়া রিণি শক্ৰমিত্র সকলের জীবনে বিষাদের ছায়াপাত করিয়া ছাড়িয়াছে। দুঃখবোধ অনেকের আরো আন্তরিক হইয়াছে এইজন্য যে তাদের কেবলই মনে হইয়াছে, সকলের মন। টানিবার জন্য রিণি যেন ইচ্ছা করিয়া নিজেকে পাগল করিয়াছে। অহঙ্কারী আত্মসচেতন রিণিকে আর কেউ মনে রাখে না, ঈর্ষা ও বিদ্বেষ সকলে ভুলিয়া গিয়াছে। এখন শুধু মনে পড়ে কি তীব্ৰ অভিমান ছিল মেয়েটার, আঘাত গ্রহণের অনুভূতি তার চড়া সুরে বাধা সরু তারের মতো মৃদু একটু ছোঁয়াচেও কি ভাবে সাড়া দিত।
সরসী অত্যন্ত বিচলিতভাবে রাজকুমারকে জিজ্ঞাসা করে, ও কেন পাগল হয়ে গেল রাজু?
রাজকুমার নির্বোধের মতো পুনরাবৃত্তি করে, কেন পাগল হয়ে গেল?
সরসী তখন নিশ্বাস ফেলিয়া বলে, না, তুমিই বা জানবে কি করে!
রাজকুমার নড়িয়া চড়িয়া সোজা হইয়া বসে।
–কিছুদিন আগে হলে তোমার প্রশ্নের জবাবে কি বলতাম জান সরসী? বলতাম, রিণি কেন পাগল হয়েছে জানি, আমার জন্য।
তোমার জন্য?
আগে হলে তাই ভাবতাম। ওরকম ভাবার যুক্তি কি কম আছে আমার! তুমি সব জান না, জানলে তোমারও তাই বিশ্বাস হত।
সরসী চুপ করিয়া বসিয়া থাকে। রাজকুমার অপেক্ষা করে, অনেকক্ষণ! সরসী কিন্তু মুখ খোলে না।
কি সব জান না, জানতে চাইলে না সরসী?
না।
বললে শুনবে না?
শুনব।
মালতীকে আমি পছন্দ করি ভেবে মালতীকে রিণি ইতিপূর্বে দুচোখে দেখতে পারত না। একদিন নিজে থেকে যেচে আমার দিকে প্রত্যাশা করে মুখ বাড়িয়ে দিয়েছিল। মাথা খারাপ হবার গোড়াতে স্যার কে. এল-এর কাছে আমার নামে বানিয়ে বানিয়ে এমন সব কথা বলেছিল যে, পরদিন তিনি আমায় ডেকে কৈফিয়ত তলব করেছিলেন, কেন তার মেয়েকে বিয়ে করব না। এখন রিণি পাগল হয়ে গেছে, কারো কথা শোনে না, আমি যা বলি তাই মেনে নেয়। শুধু তাই নয়, অন্য সময় পাগলামি করে, আমি যতক্ষণ কাছে থাকি শান্ত হয়ে থাকে। আমার জন্যে যে ও পাগল হয়েছে তার আর কত প্রমাণ চাও।
তোমার জন্য পাগল হওয়ার প্রমাণ ওগুলি নয় রাজু! শ্ৰদ্ধা ভয় বিশ্বাসের প্রমাণ, হয়তো ভালবাসারও প্রমাণ।
হয়তো কেন?
ভালবাসার কোনো ধরাবাঁধা লক্ষণ নেই রাজু।
রাজকুমার কৃতজ্ঞতা জানানোর মতো ব্যর্থ কণ্ঠে বলে, তুমি সত্যি আশ্চর্য মেয়ে সরসী। আমার বিবরণ শুনে অন্য কোনো মেয়ের এতটুকু সন্দেহ থাকত না রিণি আমায় ভালবাসত আর মাথাটা ওর খারাপ হওয়ার কারণও তাই।
রিণি তোমায় ভালবাসত কিনা জানি না রাজু, তবে সেজন্য ও যে পাগল হয় নি তা জানি। এক পক্ষের ভালবাসা কাউকে পাগল করে দিতে পারে না, যতই ভালবাসুক। রিণির পাগল হওয়ার অন্য কারণ ছিল। তোমায় যদি রিণি ভালবেসে থাকে, মনে জোরালো ঘা খেয়ে থাকে, অন্য কারণগুলিকে সেটা একটু সাহায্য করে থাকতে পারে, তার বেশি কিছু নয়। তোমার মতো সাইকলজির জ্ঞান নেই, তবে এটা আমি জোর করে বলতে পারি। ডাক্তারও তো বলেছেন, ধীরে ধীরে ইনস্যানিটি আসছিল। তোমার দায়িত্ব কিসের? তুমি কেন নিজেকে দোষী ভেবে মন খারাপ করছ? তার কোন মানে হয় না।