মাথাধরার কথাটা কিছুক্ষণের জন্য রাজকুমার ভুলিয়া গিয়াছিল, বাকি যে কয়েকটা কর্তব্য পালন করিবে ঠিক করিয়া বাড়ি হইতে বাহির হইয়াছিল, সেগুলির কথাও মনে ছিল না। নিজের বাড়ির দরজার সামনে পৌঁছিয়া মাথাধরা আর দরকারি কাজের কথা একসঙ্গে মনে পড়িয়া গেল। কিন্তু ফিরিতে আর সে পারিল না, নিজের ঘরখানার জন্য তার মন তখন ছটফট করিতেছে। জিনিসপত্রে ঠাসা ওই চারকোনা ঘরে যেন তার মাথাধরার চেয়ে কড়া যে বর্তমান মানসিক যন্ত্ৰণা তার ভালো ওষুধ আছে।
কে যায়? রাজু? একবারটি শুনে যাবে রাজু ভাই, এক মিনিটের জন্যে?
এবার দেখা গেল, মনোরমা তার দেড় বছরের ছেলেকে কোলে করিয়া ঘুম পাড়াইতেছে। কচি কচি হাত দিয়া থোকা তার আঁচলে ঢাকা পরিপুষ্ট স্তন দুটিকে জোরে আঁকড়াইয়া ধরিয়াছে। রাজকুমারের দৃষ্টি দেখিয়া মনোরমা মৃদু একটু হাসিয়া বলিল, এমন দুষ্ট হয়েছে ছেলেটা! খায় না কিন্তু ঘুমোনোর আগে ধরা চাই। মনে মনে খাওয়ার লোভটা এখনো আছে আর কি?
তুমিই ওর স্বভাবটা নষ্ট করছ দিদি। ধরতে দাও কেন? মনোরমা আবার মৃদু হাসিল।
দ্যাখ না ছাড়াবার চেষ্টা করে?
সরল সহজ আহ্বান, একান্ত নির্বিকার। পঞ্চাশ বছরের একজন স্ত্রীলোক যেন তার কাঁচা পাকা চুলে ভরা মাথা হইতে দুটি পাকা চুল তুলিয়া দিতে বলিতেছে দশ-বার বছরের এক বালককে। গিরীন্দ্রনন্দিনীর বাড়ি ঘুরিয়া আসিবার আগে হইলে হয়তো রাজকুমার কিছুমাত্ৰ সঙ্কোচ বা অস্বস্তি বোধ করিত না, এখন মনোরমার প্রস্তাবে সে যেন নিজের মধ্যে কুঁচকাইয়া গেল।
মনোরমা একটু অসন্তুষ্ট হইয়া বলিল, খোকাকে ছোঁয়ার নামেই ভড়কে গেলে! ছোট ছেলেপিলেকে ছুঁতেই তোমার এত ঘেন্না কেন বল তো রাজু ভাই?
রাজকুমার বিব্রত হইয়া বলিল, না না, ঘেন্না কে বললে, ঘেন্না কিসের!
তারপর অবশ্য মনোরমার স্তন হইতে খোকার হাত দুটি ছাড়াইয়া দিবার চেষ্টা তাকে করিতে হইল। মনোরমা স্নেহের আবেশে মুগ্ধ চোখ মেলিয়া দেখিতে লাগিল তার আধ ঘুমন্ত খোকার নির্বিকার প্রশান্ত মুখে কান্না-ভরা প্ৰচণ্ড প্রতিবাদের দ্রুত আয়োজন আর জগতের অষ্টমাশ্চর্য দেখিবার মতো বিস্ময়ভরা চোখ মেলিয়া রাজকুমার দেখিতে লাগিল মনোরমার মুখ! খোকার কচি হাত আর মনোরমার কোমল স্তনের স্পর্শ যেন অবিস্মরণীয় সুগন্ধী অনুভূতিতে ভরা তেজস্কর রসায়নের মতো তার মধ্যে নবজীবনের সঞ্চার করিতে লাগিল। তার আহত মনের সমস্ত গ্লানি মুছিয়া গেল।
খোকার হাত বেশিক্ষণ ধরিয়া রাখা গেল না, তীক্ষ্ণ গলার প্রচণ্ড আৰ্তনাদে কানে তালা ধরাইয়া সে তখন প্রাণপণে হাত-পা ছুঁড়িবার জন্য ছটফট করিতেছে।
মনোরমা বলিল, দেখলে?
রাজকুমার মেঝেতে বসিয়া বলিল, হুঁ, ছোঁড়ার সত্যি তেজ আছে!
মনোরমা হাসিভরা মুখখানা মুহুর্তে অন্ধকার হইয়া গেল। ভুরু বাকাইয়া তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে রাজকুমারের মুখের দিকে চাহিয়া তীব্র ভর্ৎসনার সুরে বলিল, ছোঁড়া বলছ কাকে শুনি?
রাজকুমার থতমত খাইয়া গেল।–আহা এমনি বলেছি, আদর করে বলেছি–
মনোরমার রাগ ঠাণ্ডা হইল না।–বেশ আদর তো তোমার! আমার ছেলেকে যদি আদর করে ছেড়া বলতে পার, আমাকেও তো তবে তুমি আদর করে বেশ্যা বলতে পার অনায়াসে। এ আবার কোন্ দেশী আদর করা, এমন কুচ্ছিৎ গাল দিয়ে!
ছোঁড়া কথাটা তো গাল নয় দিদি!
নয়? ছোঁড়া কাদের বলে শুনি? যারা নেংটি পরে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়ায়, পকেট মারে, মদ-গাজা-ভাং খায়, মেয়েদের দেখলে শিস্ দেয়, বিচ্ছিরি সব ব্যারামে ভোগে–আমি জানি না ভেবেছ!
অনেক প্রতিবাদেও কোনো ফল হইল না, আহতা অভিমানিনী মনোরমার মুখের মেঘ স্থায়ী হইয়া রহিল! নিজেই অবশ্য সে কথাটা চাপা দিয়া দিল, বলিল, সে যাকগে, থাক, ওকথা বলে। আর হবে কি, আচ্ছা আচ্ছা, তোমার কথাই রইল রাজু ভাই, তুমি কিছু ভেবে কথাটা বল নি–কিন্তু বেশ বোঝা যাইতে লাগিল, মনে মনে সে অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হইয়া আছে।
ফোন করেছ?
না, এইবার যাব।
ফোন করতেই না গেলে?
না, গিরিদের বাড়ি গিয়েছিলাম। ফোন করার কথাটা মনে ছিল না।
খেয়ালখুশির বাধা অপসারিত হওয়ায় একটু পরেই খোকা আবার ঘুমাইয়া পড়িয়াছিল। গম্ভীর। মুখে অকারণে খোকার মুখে একটা চুমা খাইয়া মনোরমা বলিল, গিরিদের বাড়ি কেন?
গিরির মা রাত্রে খেতে বলেছিল, তাই বলতে গিয়েছিলাম, আজ আর খেতে যেতে পারব না।
কে কে ছিল বাড়িতে? গিরি কি করছিল?
গিরি মার কাছে শুয়েছিল। ওরা দুজনেই বাড়িতে ছিল, এ সময় আর কে বাড়ি থাকবে?
দরজা খুলল কে?
এ রীতিমতো জেরা। মনোরমার মুখের গাম্ভীর্য যেন একটু কমিয়াছে, গলার সুরে বেশ আগ্ৰহ টের পাওয়া যায়।
রাজকুমারের একবার ক্ষণেকের জন্য মনে হইল, মনোরমাকে সব কথা খুলিয়া বলে। গিরি আর গিরির মা তাদের অসভ্য গেঁয়ো মনোবৃত্তি নিয়া অকারণে বিনা দোষে তাকে আজ কি অপমানটা করিয়াছে আর মনে কত কষ্ট দিয়াছে, সবিস্তারে জানাইয়া মনোরমার সহানুভূতি আদায় করিয়া একটু সুখ ভোগ করে। খোকাকে ছেড়া বলার জন্য মনোরমা এমন খাপছাড়া ভাবে ফোঁস করিয়া না উঠিলে সে হয়তো বিনা দ্বিধাতেই ব্যাপারটা তকে বিশদভাবে ব্যাখ্যা করিয়া শুনাইয়া দিত। এখন ভরসা পাইল না। খোকাকে উপলক্ষ করিয়া অসাধারণ ধীরতা, স্থিরতা, সরলতা আর সুবিবেচনার পরিচয় দিয়া মনোরমা তার মনে যে অগাধ শ্রদ্ধা সৃষ্টি করিয়াছিল, কয়েক মিনিট পরে খোকাকে উপলক্ষ করিয়াই মনোরমা নিজেই আবার সে শ্ৰদ্ধা নষ্ট করিয়া দিয়াছে। সব কথার ঠিক মানেই যে মনোরমা বুঝিবে, সে ভরসা রাজকুমারের আর নাই। কে জানে নিজের মনে ব্যাপারটার কি ব্যাখ্যা করিয়া সে কি ভাবিয়া বসিবে তার সম্বন্ধে!