এই মেয়েটা আবার কে কালী?
যার সঙ্গে এতক্ষণ গল্প করলেন–আপনার সরসী?
ওকে তুমি সরসীদি বলবে।
আমার বয়ে গেছে ওকে দিদি বলতে।
মুখ উঁচু করিয়া ঠোঁট ফুলাইয়া সিধা হইয়া কালী মূর্তিমতী বিদ্রোহের মতো দাঁড়াইয়া থাকে, তার চোখ দুটি কেবল জলে বোঝাই হইয়া যায়। রাজকুমার অন্যমনে রিণির কথা ভাবিতেছিল, অবাক হইয়া সে কালীর দিকে চাহিয়া থাকে। এতটুকু মেয়ের মধ্যে ভাবাবেগের এই তীব্রতা সে হঠাৎ ঠিকমতো ধারণা করিয়া উঠিতে পারে না।
কি উদ্দেশ্যে এবং কেন কিছু না ভাবিয়াই, সম্ভবত আহত সকাতর শিশুকে আদর করার স্বাভাবিক প্রেরণার বশে, কালীর দিকে সে হাত বাড়াইয়া দেয়। কালীর নাগাল কিন্তু সে পায় না, দুহাতে তাকে সজোরে ঠেলিয়া দিয়া কালী ছুটিয়া পলাইয়া যায়।
সমস্ত দুপুর রাজকুমার বিষণ্ণ হইয়া থাকে। বাহিরে কড়া রোদ, ঘরে উজ্জ্বল আলো, রাজকুমারের মনে যেন সন্ধ্যার ছায়া, অমাবস্যা রাত্রির ছদ্মবেশী আগামী অন্ধকার। একটা কষ্টবোধও যেন সমস্ত শরীরে ছড়াইয়া পড়িয়াছে, রাত্রি জাগরণের পর যেমন হয়। রাত্রে সে তো কাল ঘুমাইয়াছিল, সমস্ত রাত ঘুমাইয়া ঘুমাইয়া স্বপ্ন দেখিয়াছে?
বিকালে রাজকুমার রিণিদের বাড়ি গেল।
দারোয়ানের কাছে খবর পাওয়া গেল স্যার কে. এল বাড়িতেই আছেন, সারাদিন একবারও তিনি বাহিরে যান নাই। রিণির অসুখ, দুবার ডাক্তার আসিয়াছিল।
অসুখ? নিচের হলে গিয়া দাঁড়াইতে রিণির ভাঙা ভাঙা গানের সুর রাজকুমারের কানে ভাসিয়া আসে। তারপর হঠাৎ এত জোরে সে বাড়ির দাসীকে ডাক দেয় যে তার সেই শেষ পর্দায় তোলা তীক্ষ্ণ কণ্ঠস্বর যে ঘরের দেয়ালে, ঘরের বাতাসে, রাজকুমারের গায়ে আঁচড় কাটিয়া যায়। ডাক্তারকে দুবার আসিতে হইয়াছিল রিণির এমন অসুখ! আগাগোড়া সবটাই কি রিণির তামাশা? কেবল তার সঙ্গে নয়, বাড়ির লোকের সঙ্গেও সে কি খেলা করিতেছে–তার বিকারগ্রস্ত মনের কোনো এক আকস্মিক ও দুর্বোধ্য প্রেরণার বশে?
ধীরে ধীরে উপরে উঠিয়া রিণিকে দেখিবামাত্র এ সন্দেহ তার মিটিয়া গেল। রিণির সত্যই অসুখ করিয়াছে। তার চুল এলোমেলো, আঁচল লুটাইতেছে মেঝেতে, মুখে ও চোখে এক শ পাঁচ ডিগ্রি জ্বরের লক্ষণ। অথচ শুইয়া থাকার বদলে সে অস্থিরভাবে এদিক-ওদিক করিয়া বেড়াইতেছে। এক পাশে চেয়ারে মরার মতো হেলান দিয়া বসিয়া স্যার কে. এল হতাশভাবে তার দিকে চাহিয়া আছেন।
রাজকুমারকে দেখিয়াও রিণি যেন দেখিতে পাইল না। কেবল স্যার কে. এল হঠাৎ জীবন্ত হইয়া উঠিলেন। চেয়ার ছাড়িয়া উঠিয়া আসিয়া রাজকুমারের সামনে এক মুহূর্তের জন্য দাঁড়াইলেন, রাজকুমারকে কিছু যেন বলিবেন। তারপর একটি কথাও না বলিয়া নিঃশব্দে পাশ কাটাইয়া চলিয়া গেলেন।
ছোট বুকসেফটির কাছে গিয়া একটি একটি করিয়া বই বাছিয়া মেঝেতে ছুড়িয়া ফেলিতে ফেলিতে রিণি গুনগুনানো সুর ভজিতে লাগিল।
রিণি!
কে? অ! রিণি একটু হাসিল, বোসোনা? বইগুলো একটু বেছে রাখছি–যত বাজে বই গাদা হয়েছে।
তোমার কি হয়েছে? জ্বর?
কিছু হয় নি তো।
রাজকুমার বসিল। বই থাক রিণি। এখানে এসে বোস।
রিণি চোখের পলকে ঘুরিয়া দাঁড়াইল।–দ্যাখ, হুকুম কোরো না বলছি। এক শ বার বলি নি তোমায়, আমার সঙ্গে নরম সুরে কথা কইবে? তোমরা সব্বাই আমায় নিয়ে মজা কর জানি, তা কর গিয়ে যা খুশি, আমার আপত্তি নেই, কিন্তু ভদ্ৰভাবে করবে–রেসপেক্টফুলি।–উঃ তাই বটে, ভুলে গিয়েছিলাম। কি যেন বললে তুমি?
রাজকুমার অত্যন্ত নরম সুরে বলিল, বোসো। তোমার সঙ্গে কথা আছে।
রিণি আসিয়া পাশে বসিবার পরেও রাজকুমার তার দিকে চাহিয়া থাকে, কোন্ অনুভূতি হৃদয়ে আলোড়ন তুলিয়াছে বুঝিতে পারে না। কাছে আসিবার পর এখন রিণির চোখ দেখিয়া সে যেন বুঝিতে পারে তার কি হইয়াছে। রিণির চাহনি স্পষ্টভাবেই তার কাছে সব ঘোষণা করিয়া দেয়, কিন্তু মনে মনে রাজকুমার প্রাণপণে সে সংবাদকে অস্বীকার করে। তার মনে হয়, রিণির সম্বন্ধে এই ভয়ঙ্কর সত্যকে স্বীকার করিলে তার নিজের মাথাও যেন খারাপ হইয়া যাইবে।
রিণি ব্লাউজের বোতাম লাগায় নাই, লুটানো কাপড় তুলিয়া রাজকুমার তার গায়ে জড়াইয়া দিল। রিণির সঙ্গে এখন কথা বলা না বলা সমান, কোনো বিষয়েই তার সঙ্গে আলোচনা করার আর অর্থ হয় না। তবু তাকে বলিতে হইবে। রিণি সুস্থ আর স্বাভাবিক অবস্থাতে আছে ধরিয়া লইয়াই। তার সঙ্গে তাকে আলাপ করিতে হইবে। নতুবা নিজে সে অসুস্থ হইয়া পড়িবে কয়েক মুহূর্তের মধ্যে।
তোমার বাবাকে ওসব বলতে গেলে কেন রিণি?
রিণির মুখে বিস্ময় ফুটিয়া উঠিল।–বাবাকে? কি বলেছি বাবাকে?
আমার সম্বন্ধে?
তোমার সম্বন্ধে? কই না, কিছুই তো বলি নি বাবাকে তোমার সম্বন্ধে? বাবার সঙ্গে আমি কথাই বলি না যে!
পলকহীন দৃষ্টিতে রিণি রাজকুমারের চোখের দিকে সোজা তাকাইয়া থাকে, তার মুখের ভাবের সামান্য একটু পরিবর্তনও ঘটে না। তারপর ধীরে ধীরে স্পষ্ট হইয়া ওঠে ক্রোধের অভিব্যক্তি।
দাঁড়াও ডাকছি বাবাকে।
রাজকুমার ব্যস্ত হইয়া বলে, থাক, রিণি, থাক্। বারণ কানে না তুলিয়া সিঁড়ির মাথা পর্যন্ত আগাইয়া গিয়া তীক্ষ্ণ কণ্ঠে চিৎকার করিয়া রিণি স্যার কে. এলকে ডাকিতে থাকে, বাবা বাবা? ড্যাডি? ড্যাডি?
স্যার কে. এল উপরে আসিতেই হাত ধরিয়া তাকে সে টানিয়া আনে রাজকুমারের সামনে, কাদ কাদ হইয়া বলে, রাজুদার নামে তোমায় আমি কি বলেছি বাবা?