বাড়ি যাবে মালতী?
একটু শুয়ে থাকি। বড় অস্থির অস্থির করছে।
রাজকুমার বিছানা ছাড়িয়া উঠিয়া দাঁড়াইতে মালতী গিয়া শুইয়া পড়িল।
দরজা বন্ধ করে এতক্ষণ ঘরে বসে ছিলাম বলে বোধহয়।
তা হবে।
মিছিমিছি রুমটা নেওয়া হল।
তাতে কি।
সাতটা টাকাই নষ্ট। কি চার্জ! এক রাত্রির জন্য একটা রুম, তার ভাড়া সাত টাকা! কে জানত হঠাৎ এমন বিশ্রী লাগবে শরীরটা?
ও রকম হয় মালতী!
এক হিসাবে ভালোই হয়েছে। তুমি বেঁচে গেলে।
মালতীর ঠোঁটে এলোমেলো নড়াচড়া চলে, চোখের পাতা যেন ঘন ঘন ওঠে নামে চুলগুলি বিশৃঙ্খল হইয়া আছে। তার শোয়ার ভঙ্গিতে গভীর অবসন্নতা। মহাকাব্যের শৃঙ্গারাস্তা রমণীর বর্ণনা রাজকুমারের মনে পড়িয়া যায়।
রাজুদা একটা কথা বলি শোন। তুমি কি ভাববে জানি না। আমি একটা বিশ্রী উদ্দেশ্য নিয়ে আজ এসেছিলাম। মানে, আমার উদ্দেশ্য ভারি খারাপ ছিল।
বল কি, ভারি আশ্চর্য কথা তো!
মালতীর বিবর্ণ মুখে রঙের প্লাবন আসিয়া আটকাইয়া রহিয়া গেল।
তা নয়। ঠিক তা নয়। আমি ভেবেছিলাম, আমাকে তা হলে তুমি বাধ্য হয়ে বিয়ে করবে।
কেন? নাও তো করতে পারতাম।
তামাশা করছ? এই কি তোমার তামাশার সময় হল? আমার এদিকে মাথা ঘুরছে, কি ভাবছি কি বলছি বুঝতে পারছি না–রাগ করেছ নাকি? তুমি নিশ্চয় রাগ করেছ। তাই এমনিভাবে ছাড়া ছাড়া কথা বলছ–রাগ হয়েছে তোমার।
উৎকণ্ঠিত দৃষ্টিতে রাজকুমারের মুখের দিকে চাহিয়া তার রাগের চিহ্ন খুঁজিতে খুঁজিতে মালতী একেবারে উঠিয়া বসে।
রাগ করেছ কেন? তুমি তো জান তুমি যা চাইবে তাই হবে, আমি কথাটি বলব না। সত্যি বলছি, বিয়ের কথা আর মনেও আনব না। এতক্ষণ তাই ভাবছিলাম একটি ঘরে বসে। তুমি যখন ওসব অনুষ্ঠান পছন্দ কর না, আমার কাজ নেই বাবা বিয়ে ফিয়েতে। কিন্তু, মালতীর গলায় করুণ মিনতির সুর ফুটিয়া উঠিল, আমার একটা কথা তোমার রাখতে হবে। বল রাখবে?
কি কথা মালতী?
এক রাত্রির জন্য রুম নিয়ে নয়, চল আমরা কোথাও চলে যাই দুজনে, মাস তিনেকের জন্যে। অন্তত দুমাস। কিছুদিন এক সঙ্গে এক বাড়িতেই যদি না রইলাম–
আজ রাত্রিকে বাতিল করার সমর্থনে এই জোরালো যুক্তি মালতী আবিষ্কার করিয়াছে। আরম্ভ হওয়ার আগেই কাব্য প্রেম স্বপ্ন আর কল্পনা শুধু মনের উদ্বেগ আর দেহের অস্থিরতায় যে পরিণতি হইয়া গেল তার তো একটা কারণ থাকা চাই? সে কারণটি এই। একটি বিচ্ছিন্ন রাত্রির অসম্পূর্ণ ভাঙা প্ৰেম তার ভালো লাগবে না। কাল সকালে ছেদ পড়িবে ভাবিয়া মিলনকে সে গ্রহণ করিতে পারিতেছে না, শুধু এই কারণে দেহমন তার বিরোধী হইয়া উঠিয়াছে। রাজকুমারকে সে ভালবাসে বৈকি?
রাজকুমার নীরবে একটু হাসিল। ভাবিল, মালতী তার অর্থহীন হাসির যা খুশি মানে করুক, কিছু আসিয়া যায় না। মালতীর সঙ্গে বোঝাপড়ারও কোনো প্রয়োজন নাই। মালতী একদিন নিজেই বুঝিতে পারিবে। মালতীর পক্ষে সেভাবে সব বুঝিতে পারাই ভালো।
পরদিন ছুটি ছিল, সকালে কয়েকটি বন্ধুবান্ধব দেখা করিতে আসিল। রাজকুমার বেকার, তার ছুটিও নাই। একটু সে ঈর্ষা বোধ করিল, বন্ধুদের জীবনে কাজের দিনগুলির মধ্যে ছুটির দিন সত্য সত্যই অনেকখানি পৃথক হইয়া আসে বলিয়া। অনেক বেলায় সরসীও আসিয়া হাজির। যত বড় বড় ঘটনাই ঘটুক সরসীর জীবনে, কোনোদিন তার মনে কিছু ঘটে না, কোনোদিন সে বদলায় না, চিরদিন সে একরকম থাকিয়া গেল। আজো তার প্রকাণ্ড একটা মিটিং আছে। রাজকুমার যেন নিশ্চয় যায়। একটু প্রস্তুত হইয়াই যেন যায়, কিছু বলিতে হইবে।
সেদিনের মতো কেলেঙ্কারি কোরো না।
কেলেঙ্কারি করেছিলাম নাকি সেদিন?
প্রায়। শেষটা সামলে গেলে তাই রক্ষা। ঘরোয়া মিটিং ছিল বলে সামলে নেবার সুযোগ পেলে, পাবলিক মিটিং হলে আগেই লোকে হাসতে আরম্ভ করত।
তা হইবে। সেদিন মস্ত একটা বাহাদুরি করিয়াছে এ ধারণাটা এতদিন বজায় রাখিতে না দিয়া আগে সরসী এ খবরটা দিলে ভালো হইত।
রিণির কি হয়েছে জান?–সরসী হঠাৎ জিজ্ঞাসা করিল।
কি হয়েছে?
আমি তো তাই জিজ্ঞেস করছি। বাড়ি থেকে নাকি বার হয় না, কারো সঙ্গে দেখা করে না। পরশু গিয়েছিলাম, দরজা বন্ধ করে ঘরে কি যেন করছিল, দরজা খুলল না, ভেতর থেকেই আমায় বসতে বলল। বসে আছি তো বসেই আছি, দরজা আর খুলল না। দুবার ডাকলাম, সাড়াও দিলে না। শেষে আমি যখন ডেকে বললাম, আমার কাজ আছে আমি চললাম, একটা যাচ্ছেতাই জবাব দিলে।
কি বললে?
সে আমি উচ্চারণ করতে পারব না।
আমার সম্বন্ধে কোনো কথা?
না। তোমার সম্বন্ধে কি কথা বলবে? একটা বিশ্রী ফাজলামি করলে, একেবারে ইতরামি যাকে বলে।
আরো কিছুক্ষণ বসিয়া, কালীর সঙ্গে একটু ভাব জমানোর চেষ্টা করিয়া সরসী চলিয়া গেল। সরসীকে কালী পছন্দ করে না, রাজকুমারের সঙ্গে তাকে কথা বলিতে দেখিলেই তার মুখ কালো হইয়া যায়। এক মিনিটের বেশি কাছে থাকিতে পারে না কিন্তু ঘুরিয়া ঘুরিয়া বার বার কাছে আসে। সরসী আর রাজকুমারের মুখের দিকে তাকায়, ঠোঁট কাড়মায়, হঠাৎ একটা খাপছাড়া কথা বলে, দুপদাপ পা ফেলিয়া চলিয়া যায়।
সেদিন মনোরমার তিরস্কারের পর কালী কেমন বদলাইয়া গিয়াছে। মনোরমা যতটুকু সাজাইয়া দেয় তার উপর সে নিজে নিজে আরেকটু বেশি করিয়া সাজ করে। গায়ে একটু বেশি সাবান ঘষে, মুখে একটু বেশি ক্রিম মাখে, একটু বেশি দামের কাপড় পরে।
সরসী চলিয়া যাওয়ামাত্র সে বলিল, এই মেয়েটা এলে আপনি পৃথিবী ভুলে যান।