চুলোয় যাক। মালতীকে দুয়ার খুলিবার সঙ্কেত জানাইবার পর মালতী দুয়ার খুলিয়া দেওয়া পর্যন্ত কয়েক মুহূর্ত রাজকুমার ভাবিয়াছিল–চুলোয় যাক। কি আসিয়া যায় মালতী যদি শ্যামলকে। ভালবাসে আর সেই ভালবাসাই তাকে ঠেলিয়া দেয় তার পরম শ্রদ্ধাস্পদ রাজকুমারের দিকে, রাজকুমারকে সে শুধু ভালবাসিতে চায় বলিয়া, রাজকুমারকেই তার ভালবাসা উচিত এই ধারণা পোষণ করে বলিয়া? এ তো সর্বদাই ঘটিতেছে। ভালবাসিবার দুরন্ত ইচ্ছা যে ভালবাসা নয় এ জ্ঞান অনেকের যেভাবে আসিয়াছে মালতীরও সেভাবে আসুক–আজ রাত্রি শেষে, অথবা আগামীকাল। সে নিজে অবশ্য সব জানে। কিন্তু জানা কথা না জানার ভান করা নিজের কাছে এমন কি কঠিন? তার ফরমুলা তো বাধাই আছে–আজিকার রাত্রি স্মরণীয় হোক, কাল চুলোয় যাক।
ঘরের ভিতরে গিয়া এ ভাবটা অবশ্য তার কাটিয়া গেল। কিন্তু ঝড়ের গতিবেগের মতোই আবেগের গতি, বেগ থামিবার পরেও গতি হঠাৎ থামে না। আপনা হইতেই খানিকটা আগাইয়া। চলে।
খাটে বসিয়া রাজকুমার বলে, দেরি হয়ে গেছে, না?
মালতী অট স্বরে বলে, হ্যাঁ।
একলা কষ্ট হচ্ছিল?
আমার ভয়ানক কষ্ট হচ্ছে।
রাজকুমার এতক্ষণে মালতীর দিকে তাকায়। দেয়ালে নিচু ব্র্যাকেটে আলো জ্বলিতেছে, মেঝে আর ওপাশের দেয়ালে মালতীর ছায়া পড়িয়াছে, ছায়ায় তার শাড়ির বিন্যাস ও অবিন্যাস স্পষ্টতর। পিছনের দেয়ালের পটভূমিকায় মালতীকে দেখাইতেছে মনের ক্যামেরায় তোলা পুরোনো ফটোর মতো অস্পষ্টতার রহস্যে রহস্যময়ী–আধ-ভোলা স্মৃতি যেন ঘিরিয়া আছে তাকে। তাড়াতাড়ি কয়েকবার চোখের পলক ফেলিয়া রাজকুমার নিজের চোখের জলীয় ভ্রান্তিকেই যেন মুছিয়া দিতে চায়, তারপর হারানো গোধূলির নিম্প্ৰভ দিগন্তে সোনার থালার মতো নতুন চাদকে উঠিতে দেখিয়া শিশু যেভাবে চাহিয়া থাকে তেমনি মুগ্ধ বিস্ময়ে দেখিতে থাকে মালতীকে। সরসীকে তার মনে পড়িতেছে, হৃদয়-সাগর মন্থনে উথি তা উর্বশী সরসীকে। সে যেন কতদিনের কথা, রাজকুমার যেন ভুলিয়া গিয়াছিল। তেমনি অনবদ্য নগ্নতার প্রতিমূর্তির মতো মালতীকে ওইখানে, যেখানে সে দাঁড়াইয়া আছে কৃত্রিম আলোয় সাজানো পুতুলের মতো, দাঁড় করাইয়া দুচোখ ভরিয়া তাকে দেখিবার জন্য রাজকুমারের হৃদয় উতলা হইয়া ওঠে। দেহে মনে আবার সে যেন সেদিনের মতো নবজীবনের, মহৎ আনন্দের সঞ্চার অনুভব করে। তার আশা হয়, সরসীর মতো মালতীও আজ তাকে সমস্ত শ্রান্তি ও ক্ষোভ ভুলাইয়া দিতে পারিবে, আবার নিরুদ্বেগ মুক্তি জুটিবে তার, আবার সে উঠিতে পারিবে তার আকাশের আবাসে, যে কুলায় ছাড়িয়া নিজের ইচ্ছায় সে নামিয়া আসে নাই।
নিজের অজ্ঞাতসারে রাজকুমার উচ্চারণ করিতে থাকে, মালতী মালতী! পথহারা শ্ৰান্ত মুমূর্ষ শিশু যেভাবে তার মাকে ডাকিয়া কাতরায়।
কিন্তু মালতী শুধু মাথা নাড়ে। রাজকুমার বুঝিতে পারে না, আবার আবেদন জানায়। মালতী মাথা নাড়ে আর আঁচলের প্রান্ত দিয়া নিজেকে আরেকটু ঢাকিতে চেষ্টা করে। কথা যখন সে বলে। তার কণ্ঠস্বর শোনায় কর্কশ।
মালতী বলে, শোন। আমার কেমন যেন লাগছে।
কেমন লাগছে মালতী?
গা গুলিয়ে বমি আসছে।
ক্ৰোধ, বিরক্তি আর বিষাদে রাজকুমারের অনুভূতির আধারে ফেনিল আবর্তের সৃষ্টি হয়। তীব্র সঙ্কীর্ণ বেদনার পুনরাবৃত্তিময় সংক্ষিপ্ত আবেদন ক্ষণিকের নির্বিকার শান্তিতে লয় পায় আর আর্তনাদ করিয়া ওঠে। সে অনুভব করে, স্পষ্ট হইতে স্পষ্টতরভাবে অনুভব করে, ভয় ও শ্রদ্ধার বশ্যতা, কাব্য ও স্বপ্নের মোহ, আবেগ ও উত্তেজনার তাগিদ, কিছুই মালতীকে ভুল করিতে দিবে না। তার দিকে মালতীর গতি বন্ধ করিয়া কোনদিকে তাকে চলিতে হইবে দেখাইয়া দিবার কথা সে যা ভাবিছিল, তার কোনো প্রয়োজন ছিল না। মালতী আর আগাইবে না। সে ডাকিলেও নয়, হাত ধরিয়া টানিলেও নয়। শুধু আজ নয়, চিরদিন এই পর্যন্তই ছিল মালতীর ভুলের সীমা। ভুল কি ভুল নয় তাও হয়তো মালতী জানে না, এখনো হয়তো সে ধরিয়া রাখিয়াছে আজ রাত্রেই তার প্রিয় মিলনের রাত্রি, কিন্তু রাজকুমার দুবাহু বাড়াইয়া দিলে সে আসিয়া ধরা দিবে না।
মালতীর সম্বন্ধে এ যে তার কল্পনা নয় সে বিষয়ে রাজকুমারের এতটুকু সন্দেহ থাকে না, অশোকতরুমূলে ক্লেশপাণ্ডুরবর্ণা অধোমুখী সীতার দিকে চাহিয়া দেবতা ব্রহ্মা আর রাক্ষসী নিকষার পুত্র রাবণ যে যন্ত্রণায় অমরত্বের প্রতিকার চাহিত, রাজকুমারও তেমনি যন্ত্রণা ভোগ করে। রাবণের তবু মন্দোদরী ছিল, জীবনে রাবণ তবু ভালবাসিয়াছিল সেই একটিমাত্র নারীকে, একটু যে ভালবাসিবে রাজকুমার এমন তার কেউ নাই। তাছাড়া, তার সীতাকে সে ফিরাইয়া দিতে। চাহিয়াছিল। প্ৰায় গায়ের জোরের মতোই ব্যক্তিত্বের প্রভাবকে ছল বল কৌশল করিয়া রাখিয়া এতদিন সে মালতীকে হরণ করিয়া রাখিয়াছিল, আজ ভাবিয়ছিল তার মনটি পর্যন্ত মুক্ত করিয়া শ্যামলকে ফিরাইয়া দিবে। এই উদারতার কল্পনাটুকু পর্যন্ত তার মিথ্যা, অকারণ অহঙ্কার বলিয়া প্রমাণিত হইয়া গেল!
নিছক অহঙ্কার, অতি সস্তা আত্মতৃপ্তি, নিজেকে কেন্দ্ৰ করিয়া শিশুর মতো রূপকথা রচনা করা। মালতী কবে তার বশে ছিল যে আজ তাকে মুক্তি দেওয়ার কথা সে ভাবিতেছিল? কোনোদিন কিছু দাবি করে নাই বলিয়াই তার সম্বন্ধে মালতীর মোহ এতদিন টিকিয়া ছিল, দাবি জানানো মাত্র মালতী ছিটকাইয়া দূরে সরিয়া যাইত, হয়তো ঘৃণা পর্যন্ত করিতে আরম্ভ করিত তাকে।