তোমার সম্বন্ধে আমার অন্য ধারণা ছিল, রাজু। আমার একটা অহঙ্কার আছে, আমি মানুষ চিনতে পারি। এখনো আমি বিশ্বাস করতে পারছি না, তোমার সম্বন্ধে ভুল করেছিলাম, তুমি এত বড় রাস্কেল। সোজাসুজি কয়েকটা কথা আলোচনা করার জন্য তোমাকে তাই ডেকে পাঠিয়েছি।
আলোচনা করে লাভ কি হবে?
রিণি আমার মেয়ে রাজু। আমার আর ছেলেমেয়ে নেই!
এ কথাটা কেন বললেন বুঝতে পারছি না।
স্যার কে. এল পাইপটা মুখে তুলিয়া কামড়াইয়া ধরিলেন, তারপর আবার নামাইয়া রাখিলেন।
তুমি সব অস্বীকার করতে চাও?
না, অস্বীকার করতে চাই না। রিণির সঙ্গে অভদ্রতা করেছি, কিন্তু আমার উদ্দেশ্য খারাপ ছিল না। আমার কি উদ্দেশ্য ছিল বলে লাভ নেই। আপনি বুঝতে পারবেন না, বিশ্বাসও করবেন না।
অভদ্রতা! কি বলছ তুমি?
রাজকুমার কিছুই বলিল না। রিণির সঙ্গে তার ব্যবহারের সংজ্ঞা লইয়া কি স্যার কে. এল তর্ক করিতে চান? বলিতে চান ওটা অভদ্রতার চেয়ে আরো খারাপ কিছু?
ফাঁসির ভয় না থাকলে তোমায় আমি খুন করতাম রাজু। তুমি রিণির যা ক্ষতি করেছ সে জন্য নয়, তোমার এই মনোভাবের জন্য। রিণির কাছে সব শুনেও তোমায় আমি একা দোষী করি নি। রিণি ছেলেমানুষ নয়, তারও উচিত ছিল নিজেকে বাঁচিয়ে চলা। দুদিন ধরে আমি ক্রমাগত নিজেকে কি বুঝিয়েছি জান? কেবল তুমি আর রিণি নও, আরো অনেক ছেলেমেয়ে এ রকম ভুল করেছে, রিণি আমার মেয়ে বলেই আমার মাথা খারাপ করলে চলবে না, ভুল করলে চলবে না। রিণিকে তুমি বিয়ে করবে কিনা, না করলে কেন করবে না, খোলাখুলিভাবেই এই কথা জিজ্ঞেস করব বলে তোমাকে ডেকে পাঠিয়েছিলাম। কিন্তু এক বছর একটি মেয়ের সঙ্গে খেলা করা যখন তোমার কাছে শুধু অভদ্রতা, তোমাকে আর কিছু জিজ্ঞেস করতে চাই না। তোমাকে বলা বৃথা, তবু বলছি, যদি পার সুইসাইড কোরো। তোমার মতো মন নিয়ে কারো বেঁচে থাকা উচিত নয়। আচ্ছা, এবার তুমি যাও রাজু।
কথা বলিতে রাজকুমারের সাহস হইতেছিল না। রিণি সব বলিয়াছে যা ঘটে নাই, যা ঘটিতে পারিত না। কিছুই বলিতে বাকি রাখে নাই! কেন বলিয়াছে? কি চায় রিণি? তার উদ্দেশ্য কি? যতই বিকার থাক মনে, রিণি তো পাগল নয়। তাকে জড়াইয়া বাপের কাছে এই অদ্ভুত অকথ্য কাহিনী সে বলিতে গেল কেন? তাকে সে পাইতে চায়, বিবাহের মধ্যে, চিরদিনের জন্য? কিন্তু তাকে পাওয়ার জন্য এই উদ্ভট উপায় অবলম্বন করিবে কেন? রিণি তো কোনোদিন জানিতেও দেয় নাই, তাকে তার চাই।
যদি ধরা যায় তখন রিণিও নিজেকে জানি না, সেদিনকার রাগারাগির পর এতদিনের অদর্শনে তার খেয়াল হইয়াছে, নিজেই তাকে ক্ষমা করিয়া তাকে তো সে কাছে ডাকিতে পারি, চেষ্টা করিতে পারিত তাকে জয় করার। এই চেষ্টা ব্যর্থ হইলে, তাকে পাওয়ার আর কোনো উপায় খুঁজিয়া না পাইলে রিণি যদি এই পাগলামি করিত, তার একটা মানে বোঝা যাইত।
তোমায় যেতে বলেছি রাজু।
কাল আমি একবার রিশি সঙ্গে দেখা করতে চাই।
স্যার কে. এল সন্দিগ্ধভাবে বলিলেন, কেন?
রাজকুমার উঠিয়া দাঁড়াইল। আপনার সঙ্গে কথা বলার আগে রিণির সঙ্গে আমার কথা বলা দরকার। এমন তো হতে পারে, আপনি সব কথা জানেন না, রিণি আপনাকে সব বলতে পারে নি? আপনি ধরে নিন, রিণি আর আমার মধ্যে কয়েকটা ভুল বোঝা আছে, ধরে নিয়ে কাল তার সঙ্গে দেখা করার অনুমতি দিন।
ব্লটিং প্যাডের দিকে চাহিয়া স্যার কে. এল চুপ করিয়া বসিয়া রহিলেন।
একটু অপেক্ষা করিয়া রাজকুমারও নীরবে বাহির হইয়া গেল।
পথে নামিয়া মালতীর কাছে তাড়াতাড়ি ফিরিয়া যাওয়ার জন্য রাজকুমার ট্যাক্সি ডাকিল না, ধীরে ধীরে হটিয়া চলিতে লাগিল। দেহে মনে সুন্দর সরসীকে আশ্ৰয় করিয়া সে যে আনন্দের জগতে উঠিয়া গিয়াছিল, সেখান হইতে আবার মাটিতে নামিয়া আসিতে হইয়াছে। চলিতে চলিতে রাজকুমারের মনে হয় সে কি সত্যই কিছু পাইয়াছিল, আনন্দ অথবা শান্তি? এখন তো তার মনে হইতেছে, কয়েকটা দিন সে শুধু অন্যমনস্ক হইয়া থাকিবার সুযোগ পাইছিল।
০৬. চলিতে চলিতে মালতীর কথা ভাবিয়া
চলিতে চলিতে মালতীর কথা ভাবিয়া রাজকুমার শ্রান্তি বোধ করে। কি মধুর ছিল মালতী সম্পর্কে তার গুরুতর কর্তব্যের কল্পনা কয়েক মুহূর্ত আগে! মালতীকে ভালোভাবে বুঝাইয়া দিতে হইবে মালতী কি চায়। জীবনের স্রোতে ভাসিয়া চলিতে চলিতে একটি বিচ্ছিন্ন ফুল অস্থায়ী বাধায় আটকাইয়া গিয়াছে, ভাবিতেছে এইখানে বুঝি তার ভাসিয়া চলার শেষ, আবার তাকে ভাসিয়া যাওয়ার সুযোগ দিতে হইবে তার নিজস্ব পরিণতি, স্থায়ী সার্থকতার দিকে। এই কাজটুকু করিবে ভাবিয়াই নিজেকে রাজকুমারের দেবতা মনে হইতেছিল। ভীরু দুর্বল মানুষের মতো এখন তার মনে হইতে থাকে, মালতীর মুখোমুখি হওয়া একটা বিপদ, মালতীকে কিছু বোঝানোর চেষ্টা বিপজ্জনক সম্ভাবনায় ভরা।
অবিশ্বাস্য, তবু সত্য। মালতী যে ঘরে তার প্রতীক্ষা করিতেছিল তার রুদ্ধ দরজায় টোকা। দেওয়ার সময় রাজকুমার পূর্ণমাত্রায় সচেতন হইয়া উঠিল যে, দরজার ওপাশে মালতীর স্পর্শ ছাড়া আর সমস্তই অর্থহীন। কথা অবশ্য সে বলিতে পারে যত খুশি, কিন্তু কথার কোনো মানে থাকিবে না। স্যার কে. এল-এর স্যাম্পেনের বোতল খোলার আওয়াজের মতো কথা হইবে শুধু তৃষ্ণার সঙ্কেত, পানীয়ের আহ্বান।
আজ হঠাৎ নয়, চিরদিন এমনি ছিল, মনের অনেক দরজার ওপাশে অনেক মালতীর স্পৰ্শ। এইমাত্র শুধু সেটা জানা গেল। আকাশের মেঘে সে বাসা বাঁধিয়াছিল, সেখান হইতে নামাইয়া আনিয়া রিণি তাকে মাটিতে আছড়াইয়া ফেলিয়াছে, তাই জানা গেল। সন্দেহ করার ভরসাও তার নাই। অভিজ্ঞতার মতো এভাবে যা জানা যায় তাতে কি আর ভুলের সুযোগ থাকেঃ একটি রহস্য শুধু এখন বিস্ময়ের মতো জাগিয়া আছে যে, মালতী কেন? যার জন্য নিজের স্নেহকে একদিন ভালবাসা মনে হইয়াছিল, সে কেন? রিণি আর সরসী থাকিতে মালতী কেন এ অভাবনীয় রূপকে পরিণত হইয়া গেল?