রাজকুমার বলিল, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মানুষ দেখছিলাম মালতী, দেখতে দেখতে একটা অন্যায় করে ফেলেছি।
সে কি?
এদিক থেকে একজন মহিলা আসছিলেন, সামনে দিয়ে পাশ কাটিয়ে যাবেন। যখন কাছাকাছি এলেন, আমি বুঝতে পারলাম তিনি আশা করছেন আমি একটু পিছু হটে তাকে পাশ কাটাবার আরেকটু জায়গা দেব। ভদ্রতা করে এক পা পিছু হটতে গিয়ে আরেকজনের পা মাড়িয়ে দিলাম, ছোটখাটো একটু ধাক্কাও লাগল। যার পা মাড়িয়ে দিলাম তিনি ঠিক মহিলা নন, কমবয়সী একটি বিদেশী মেয়ে।
তারপর?
ঘুরে দাঁড়িয়ে বুঝলাম অন্তত গালে একটা চড় সে মারবেই। আমি অ্যাপলজি পর্যন্ত চাইলাম না। চুপ করে দাঁড়িয়ে তার চোখের দিকে তাকিয়ে রইলাম। কুড়ি কি বাইশ সেকেন্ড। তারপর হঠাৎ মুখ ঘুরিয়ে সে চলতে আরম্ভ করল। কি বলে গেল জান?—সরি।
তারপর?
তারপর আবার কি?
তোমার চোখের দিকে কুড়ি-বাইশ সেকেন্ড তাকিয়ে থেকেই মেয়েটার রাগ জল হয়ে গেল কেন বুঝিয়ে বলবে না? ওটাই তো আসল কথা–গল্পের মরাল। আচ্ছা আমিই বলছি শোন। ভুল হলে করেক্ট করবে। তোমার চোখের দিকে তাকিয়ে সে বুঝতে পেরেছিল, মানুষ ভালো, মানুষ কখনো অন্যায় করে না, সমস্ত অন্যায় আপনি ঘটে যায় ওগুলি জীবনের অ্যাসিডেন্ট। ঠিক হয় নি?
মালতী আজ রাজকুমারকে খোঁচা দিয়াছে, ব্যঙ্গ করিয়াছে। মালতীর পক্ষে এটা একেবারে অসম্ভব বলিয়া জানিত কিনা রাজকুমার, তাই অনেকদিন পরে আজ ভালো করিয়া তার মুখের দিকে চাহিয়া দেখিল-—মুখের ভাব না দেখিয়া কোনো কথার মানে বোঝা যায় না অনেক সময়। শহরের শৌখিন প্ৰান্তর ডিঙাইয়া শেষ বেলার রোদ তাদের গায়ে আসিয়া পড়িয়াছে, তাপের চেয়ে সে রোদের রং বেশি। মালতীর বিবৰ্ণ মুখে সত্যই তার কথার ব্যাখ্যা ছিল।
রাজকুমার জিজ্ঞাসা করিল, তোমার কি অসুখ করেছে?
না। অসুখ করে নি।
বাড়িতে না ডেকে এখানে আমাকে অপেক্ষা করতে বললে কেন মালতী?
বাড়ির বাইরে তোমার সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছে হল তাই। হয় নিজের বাড়িতে নয় অন্য কারো বাড়িতে তোমার সঙ্গে এতদিন কথা বলেছি। আমায় একদিন সিনেমায় পর্যন্ত তুমি নিয়ে যাও নি আজ পর্যন্ত।
রাজকুমার একটু ভাবিল।
সাড়ে ছটার সময় স্যার কে. এল-এর সঙ্গে দেখা করতে হবে। পিওন দিয়ে চিঠি পাঠিয়েছিলেন। এমন করে লিখেছেন দেখা করার জন্য, একটা কিছু গোলমাল হয়েছে মনে হচ্ছে। স্যার কে. এল-কে ফোন করে দিই, সাড়ে নটার সময় বাড়ি গিয়ে দেখা করব। তারপর সিনেমায় যাবে তো চল।
না। আগে দেখা করে হাঙ্গামা চুকিয়ে এস।
তুমি এতক্ষণ কি করবে?
আমিঃ এক কাজ করা যাক, হোটেলে একটা রুম নাও। তুমি স্যার কে. এল-এর সঙ্গে দেখা করতে যাবে, আমি বিশ্রাম করব—শুয়ে থাকব একটু।
তুমি লক্ষ্মী মেয়ে, মালতী!
ছেলেমানুষ নই?
আগে ছিলে, এখন কি আর তোমায় ছেলেমানুষ বলা যায়? তুমি অনেক কষ্ট পেয়েছ মালতী! আজ থেকে তুমি সুখী হবে।
শুনিয়া মালতীর ভয় করিতে থাকে। সুখ-দুঃখের কথা সে কখনো ভাবে নাই। সুখে অথবা দুঃখে কোনোদিন তার সচেতন হইতে খেয়াল থাকে নাই আমি সুখী অথবা আমি দুঃখী। নিজের সম্বন্ধে নিজের বিচারে এই হিসাবটা তার চিরদিন বাদ পড়িয়াছে। একটা অজানা মধ্যবিত্ত ফিরিঙ্গি হোটেলের একটি ঘরে তাকে রাখিয়া রাজকুমার স্যার কে. এল-এর সঙ্গে দেখা করিতে চলিয়া গেলে নিজেকে মালতীর বড় অসহায় মনে হইতে থাকে। অপরিচিত আবেষ্টনীতে নিজেকে একা মনে করিয়া নয়, বাঁচিয়া থাকার মতো সহজ স্বাভাবিক ব্যাপারটা হঠাৎ অতি বেশি গুরুত্বপূর্ণ হইয়া উঠিয়াছে বলিয়া। তার নিজের একটা জীবন আছে, জীবন যাপনের কঠিন আর জটিল কৰ্তব্য তাকে পালন করিতে হইবে, কিন্তু সে কিছুই জানে না, কিছুই বোঝে না। তার বুদ্ধি নাই, সাহস নাই, অভিজ্ঞতা নাই। রাজকুমার যাই বলুক, সে সত্যই ছেলেমানুষ, এতকাল শুধু ছেলেখেলা করিয়াছে, ছেলেখেলা করা ছাড়া আর কোনো যোগ্যতা তার নাই। জীবন তো ছেলেখেলার ব্যাপার নয়!
হোটেলটি বড় রাস্তা হইতে খানিকটা তফাতে, পথের শব্দ কানে আসে না। হোটলটিও ছোট এবং প্রায় নিঃশব্দ। হোটেলের লোক খাটে দুজনের বিছানায় ফর্সা চাদর পাতিয়া পাশাপাশি দুটি করিয়া বালিশ রাখিয়া গিয়াছে। ছোট গোল চায়ের টেবিলের দুদিকে দুখানা চেয়ার! চারটি বড় বড় জানালায় এমন কৌশলে পর্দা দেওয়া যে ঘরের মধ্যে আলো আসে কিন্তু মানুষের দৃষ্টি আসে না। দেয়াল যেন সবুজ রঙে গম্ভীর হইয়া আছে। ড্রেসিং টেবিলে প্রসাধনের আয়োজনের অভাব মালতীর অসম্পূর্ণতার অনুভূতিকে জোরালো করিয়া তোলে। আয়নায় যে মালতীকে দেখা যায় তাকে মালতীর মনে হয় অন্য একটি মেয়ে।
শেষ মুহূর্তে রাজকুমার মালতীকে একা রাখিয়া স্যার কে. এল-এর সঙ্গে দেখা করিতে যাওয়ার ব্যবস্থাটা বাতিল করিয়া দিতে চাহিয়াছিল, মালতী রাজি হয় নাই।
না, সব হাঙ্গামা চুকিয়ে দিয়ে এস। আমার সঙ্গে কথা বলবে, আর মনে মনে ভাববে রিণির বাবা কি জন্যে ডেকে পাঠিয়েছেন, আমার তা সইবে না।
তা ভাবব না মালতী! ওটুকু মনের জোর আমার আছে।
মনের জোরের কথা নয়।
রাজকুমার চলিয়া যাওয়ার পর, আধ ঘণ্টার মধ্যে মালতী অস্থির হইয়া উঠিল। সময় যে এত শ্লথ, শুইয়া বসিয়া ঘরের মধ্যে পাক দিয়া আর ক্রমাগত কজিতে বাধা ঘড়িটির দিকে চাহিয়া সময়কে যে কিছুতেই তাড়াতাড়ি পিছনে ঠেলিয়া দেওয়া যায় না, আজ যেন সে তা জানতে পারিল প্রথম। অথচ মনে মনে সে কামনা করিতে লাগিল, রাজকুমারের ফিরিতে যেন দেরি হয়। অনেক দেরি হয়।