কোথা পালাচ্ছ? শুনে যাও?
একধাপ সিঁড়িতে উঠিয়া গিরি দাঁড়াইল এবং সেইখানে দাঁড়াইয়া রাজকুমার যা বলিতে আসিয়াছে শুনিল। তারপর কাতরভাবে অভিমানের ভঙ্গিতে খোঁচা দেওয়ার সুরে বলিল, তা খাবেন কেন গরিবের বাড়িতে!।
আমার ভীষণ মাথা ধরেছে গিরি।
মাথা আমারও ধরে। আমি তো খাই!
তুমি এক নম্বরের পেটুক, খাবে বৈকি!
আমি পেটুক না আপনি পেটুক? সেদিন অতগুলো ক্ষীরপুলি–গিরি খিলখিল করিয়া হাসিয়া ফেলিল। ড়ুরে শাড়ি সংক্রান্ত কুৎসিত সঙ্কেতের বিরক্তি সঙ্গে সঙ্গে রাজকুমারের মন হইতে মিলাইয়া গেল রোদের তেজে কুয়াশার মতো। একটু গ্লানিও সে বোধ করিতে লাগিল। নিজের অতিরিক্ত পাকা মন নিয়া জগতের সরল সহজ মানুষগুলিকে বিচার করিতে গিয়া হয়তো আরো কতবার সে অমনি অবিচার করিয়াছে। নিজের মনের আলোতে পরের সমালোচনা সত্যই ভালো নয়।
কৈফিয়ত দেওয়ার মতো করিয়া সে বলিল, সন্ধ্যা থেকে ঘর অন্ধকার করে শুয়ে থাকব। কিনা, তাই খেতে আসতে পারব না।
খেয়ে গিয়ে বুঝি শুয়ে থাকা যায় না?
খেলে মাথার যন্ত্রণা বাড়ে। আজ উপোস দেব ভাবছি।
গিরি গম্ভীর হইয়া বলিল, না খেলে মাথাধরা আরো বাড়বে। শরীরে রক্ত কম থাকলে মাথা ধরে। খাদ্য থেকে রক্ত হয়।
রাজকুমার হাসিয়া বলিল, তোমার সেই ডাক্তার বলেছে বুঝি যে তোমার নাড়ি খুঁজে পায় নি?
কয়েক মাস আগে গিরির জ্বর হইয়াছিল, দেখিতে আসিয়া ডাক্তার নাকি তার কজি হাতড়াইয়া নাড়ি খুঁজিয়া পান নাই। হয়তো নাড়ি খুব ক্ষীণ দেখিয়া মন্তব্য করিয়াছিলেন, গিরির পা নাই। সেই হইতে গিরি সগর্বে সকলের কাছে গল্প করিয়া বেড়ায়, সে এমন আশ্চর্য মেয়ে যে তার পাস পর্যন্ত নাই। সকলের যা আছে তার যে তা নাই, এতেই গিরির কত আনন্দ, কত উত্তেজনা। রাজকুমারের কাছেই সে যে কতবার এ গল্প বলিয়াছে তার হিসাব হয় না। রাজকুমার অনেকবার তাকে বুঝাইয়া বলিয়াছে, কিভাবে মানুষের হার্টের কাজ চলে, কিভাবে শিরায় শিরায় রক্ত চলাচল করে–অনেক কিছু বুঝাইয়া বলিয়াছে। বোকা মেয়েটাকে নানা কথা বুঝাইয়া বলিতে তার বড় ভালো লাগে। কিন্তু গিরি বুঝিয়াও কিছু বুঝিতে চায় না।
সত্যি আমার নাড়ি নেই। আপনার বুঝি বিশ্বাস হয় না?
বাঁচিয়া থাকার সঙ্গে নাড়ির স্পন্দন বজায় থাকার অবিচ্ছেদ্য সম্পর্কের কথাটা রাজকুমার অনেকবার গিরিকে বুঝাইয়া বলিয়াছে, কোনোদিন তার হাত ধরিয়া নাড়ির অস্তিত্ব প্রমাণ করার চেষ্টা করে নাই। আজ সোজাসুজি গিরির ডান হাতটি ধরিয়া বলিল, দেখি কেমন তোমার নাড়ি নেই।
গিরি বিব্রত হইয়া বলিল, না না, আজ নয়। এখন নয়।
রাজকুমার হাসিমুখে বলিল, এই তো দিব্যি টি্প্টিপ্ করছে পাল্স।
গিরি আবার বলিল, থাক না এখন, আরেকদিন দেখবেন।
গিরির মুখের ভাব লক্ষ করিলে রাজকুমার নিশ্চয় সঙ্গে সঙ্গে তার হাত ছাড়িয়া দিয়া তফাতে সরিয়া যাইত এবং নিজের পাকা মনের আলোতে জগতের সহজ সরল মানুষগুলিকে বিচার করিবার জন্য একটু আগে অনুতাপ বোধ করার জন্য নিজেকে ভাবিত ভাবপ্রবণ। কিন্তু গিরির সঙ্গে তামাশা আরম্ভ করিয়া অন্যদিকে তার মন ছিল না।
হাসির বদলে মুখে চিন্তার ছাপ আনিয়া সে বলিল, তোমার পালস্ তো বড় আস্তে চলছে গিরি। তোমার হার্ট নিশ্চয় খুব দুর্বল। দেখি
ড়ুরে শাড়ির নিচে যেখানে গিরির দুর্বল হার্ট স্পন্দিত হইতেছিল, সেখানে হাত রাখিয়া রাজকুমার স্পন্দন অনুভব করার চেষ্টা করিতে লাগিল। গিরির মুখের বাদামি রং প্রথমে হইয়া গেল পশুটে, তারপর হইয়া গেল কালেটে। একে আজ গায়ে তার সেমিজ নাই, তারপর চারিদিকে নাই মানুষ। কি সৰ্বনাশ!
ছি ছি! এসব কি!
রাজকুমার আশ্চর্য হইয়া বলিল, কি হয়েছে?
গিরি দমক মারিয়া তার দিকে পিছন ফিরিয়া, একবার হোঁচট খাওয়ার উপক্রম করিয়া তরতর করিয়া সিঁড়ি বাহিয়া উপরে উঠিয়া গেল। রাজকুমার হতবাক হইয়া চাহিয়া রহিল। একি ব্যাপার?
ব্যাপার বোঝা গেল কয়েক মিনিট পরে উপরে গিয়া। গিরির মা পাটিতে পা ছড়াইয়া হাতে ভর দিয়া বসিয়া আছেন। দেখিলেই বোঝা যায়, সবে তিনি শয়নের আরাম ছাড়িয়া গা তুলিয়াছেন–বসিবার ভঙ্গিতেও বোঝা যায়, মুখের ভঙ্গিতেও বোঝা যায়। মানুষটা একটু মোটা, গা তোলার পরিশ্রমেই বোধহয় একটু হাঁপও ধরিয়া গিয়াছে।
রাজকুমার বলিতে গেল, গিরি—
গিরির মা বাধা দিয়া বলিলেন, লজ্জা করে না? বেহায়া নচ্ছার কোথাকার।
এমন সহজ সরল ভাষাও যেন রাজকুমার বুঝিয়া উঠিতে পারি না, হাঁ করিয়া চাহিয়া রহিল। গিরির মা আবার বলিলেন, বেরো হারামজাদা, বেরো আমার বাড়ি থেকে।
গিরির মার রাগটা ক্রমেই চড়িতেছিল। আরো যে কয়েকটা শব্দ তার মুখ দিয়া বাহির হইয়া পড়িল সেগুলি সত্যই অশ্ৰাব্য।
রাজকুমার ধীরে ধীরে রসিকবাবুর বাড়ি ছাড়িয়া বাহির হইয়া আসিল, ক্ষুব্ধ আহত ও উদ্ভ্রান্ত রাজকুমার। ব্যাপারটা বুঝিয়াও সে যেন ভালো করিয়া বুঝিয়া উঠিতে পারিতেছিল না। হঠাৎ যেন একটা যুক্তিহীন ভূমিকাহীন আকস্মিক দুর্ঘটনা ঘটিয়া গিয়াছে। তার কেবলই মনে হইতে লাগিল, দামি জামাকাপড় পরিয়া খুব উৎসাহের সঙ্গে সে বাড়ির বাহির হইয়াছিল, হঠাৎ কিভাবে যেন পচা পাক ভরা নর্দমায় পড়িয়া গিয়াছে। এইরকম একটা আকস্মিক দুর্ঘটনার পর্যায়ে না ফেলিয়া এ ব্যাপারটা যে সত্য সত্যই ঘটিয়া গিয়াছে এ কথা কল্পনা করাও তার অসম্ভব মনে হইতেছিল।
নিছক দুর্ঘটনা–কারো কোনো দোষ নাই, দোষ থাকা সম্ভব নয়। ভুল বুঝিবার মধ্যে তো যুক্তি থাকে মানুষের, ভুল বুঝিবার সপক্ষে ভুল যুক্তির সমর্থন? গায়ে কেউ ফুল ছুড়িয়া মারিলে মনে হইতে পারে ফাজলামি করিয়াছে, সহানুভূতির হাসি দেখিয়া মনে হইতে পারে ব্যঙ্গ করিতেছে, কিন্তু ফুল আর হাসির আঘাতে হত্যা করিতে চাহিয়াছে একথা কি কোনোদিন কারো মনে হওয়া সম্ভব? কতটুকু মেয়েটা! বুকের স্পন্দন পরীক্ষা করিবার সময় বুকটা তার বালকের বুকের মতো সমতল মনে হইয়াছিল। যে মেয়ের দেহটা পুরুষের উপভোগের উপযুক্ত হইতে আজো পাঁচ-সাত বছর বাকি আছে সেই মেয়ের মনে তার সহজ সরল ব্যবহারটির এমন ভয়াবহ অর্থ কেমন করিয়া জাগিল?