মালতীর বাড়ি গিয়া দেখা গেল, সরসী আর রুক্মিণী আসিয়াছে। দুজনেই বিশেষভাবে সাজিয়াছে, মালতীও দামি কাপড় পরিয়া নামিয়া আসিল। তিনজনে বিবাহের নিমন্ত্রণ রাখিতে যাইবে শ্যামলের সঙ্গে।
নিমন্ত্রণে যাওয়ার আগ্রহ তিনজনেরই প্রবল, শ্যামলের দেরির জন্য কারো কিন্তু বিরক্তি দেখা গেল না।
বোন আর বৌদিকে নিয়ে আসবে।–মালতী বলিল।
দেরি করার অপরাধ তাই শ্যামলের নয়। দুটি মেয়েকে সঙ্গে আনিতে হওয়ায় দেরি যে তার হইবে, এটা সকলে ধরিয়াই রাখিয়াছে।
রাজকুমার বলিল, আমি তবে বিদায় হলাম।
সরসী বলিল, তুমিও চল না আমাদের সঙ্গে?
অনাহূত?
অনাহূত মানে? ধীরেনবাবু তোমায় বলেন নি?
তোমরা ধীরেনের বিয়েতে যাচ্ছ নাকি? এ তো ভারি আশ্চর্য যোগাযোগ হল!
আশ্চর্য যোগাযোগ আবার হল কোখানটায়? তুমি ধীরেনবাবুর সঙ্গে আমার পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলে, আমি চেষ্টা করে একটা চেনা মেয়ের সঙ্গে তার বিয়ে দিয়ে দিচ্ছি। আমরা যাচ্ছি কন্যা পক্ষে, তুমি যাবে বরযাত্রী হয়ে। এ তো সোজা কথা।
আগে জানিলে কথাটা সোজাই মনে হইত। একটা বিবাহ ঘটানোর গর্বে এখন বিশ্বের, সমস্ত ঘটনা নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা সরসীর আয়ত্তে আসিয়াছে, আশ্চর্য কিছু ঘটিবার উপায় নাই। রাজকুমার যে ঠিক আজ সন্ধ্যাতেই অনেকদিন পরে মালতীর ঘেঁজ করিতে আসিয়াছে, তাও সরসীরই বাহাদুরি। ধীরেনের দু বছর খোঁজার পর পছন্দমতো মেয়ে পাওয়ার ব্যাপারটা রাজকুমার এবার বুঝিতে পারে। সরসীই তার মনে পড়াইয়া দেয় তার বাড়িতে মেয়েটিকে রাজকুমার একদিন দেখিয়াছিল। না, দু বছর খুঁজিয়া পছন্দ করার মতো মেয়ে সে নয়। তবে মাঝখানে সরসী ছিল। সেই পছন্দ করাইয়া দিয়াছে সন্দেহ নাই। সরসী সব পারে।
সকলকে আড়াল করিয়া সরসী একাই তার সঙ্গে কথা বলে। চিরদিন তার এই রীতি। দেখা হওয়ামাত্র রাজকুমারকে সে দখল করে। মনে হয়, রাজকুমারের জন্যই সে যেন ওত পাতিয়া ছিল। তার সভা-সমিতি করিয়া বেড়ানোর মানে আর কিছুই নয়, রাজকুমারের অদর্শনের কটা দিন বাজে কাজে কোনো রকমে সে সময় কাটায়।
মালতী বলে, তোমায় কেমন আনমনা ঠেকছে আজ?
সরসী সঙ্গে সঙ্গে রাজকুমারের হইয়া জবাব দেয়, কবিত্ব করিস নে মালতী, থাম। একটা মানুষ ভালো করে চুল না আঁচড়ালেই তোর কাছে আনমনা ঠেকে। চিরুনিটা দেখি তোর।
সরসী নিজেই মালতীর চিরুনি দিয়া রাজকুমারের চুল ঠিক করিয়া দেয়। তার পিছনে দাঁড়াইয়া মালতী একটু হাসে।
রুক্মিণী বলে, চুল আঁচড়ালে কি হবে, রাজকুমারবাবুর চেহারাটাই কবির মতো।
সরসী মুখে এ কথার প্রতিবাদ করে না, শুধু ভৎসনার দৃষ্টিতে রুক্মিণীর মুখের দিকে তাকায়। রুক্মিণী একেবারে বিব্রত হইয়া পড়ে। কারো চোহারা কবির মতো, এ কথা বলা কি অসঙ্গত? প্রশংসার বদলে তাতে কি নিন্দা বুঝায়? কে জানে! অথচ সদ্য পরিচিত একজনকে ঠিক এই কথা বলায় পরদিন সকালে সে বাড়ি আসিয়া রুক্মিণীর সঙ্গে আলাপ করিয়া গিয়াছিল।
তাড়াতাড়ি সে আবার বলিতে যায়, কবির মতো চেহারা মানে—
সরসী বলে, মানে, ওকে তোমার খুব পছন্দ হয়ে গেছে!
এবার রুক্মিণী নিৰ্ভয়ে সহজভাবে জবাব দেয়, তা হয়েছে। তবে এক পক্ষের পছন্দে আর লাভ কি!
রাজকুমার মনে মনে তার নিজস্ব অপদেবতার কাছে কাতর প্রার্থনা জানায়। কিন্তু উপায় তো নাই, কথার পিঠে কথা চাপাইতেই হইবে। কোনো রকমে একটু হাসিয়া সে বলে, এ অনুমানটা আপনার ভুল।
ভুল নয় রাজকুমারবাবু, প্রমাণ আছে। পছন্দ দূরে থাক, আমায় আপনি অপছন্দ করেন।
আগে আপনার প্রমাণ দাখিল করুন, আসামি জবাবদিহি করবে।
রুক্মিণী মৃদু মৃদু হাসে। এ ধরনের আলাপের সময় সকলেই হাসে, তবে ঠিক এ ভাবে নয়! কেমন যেন বাকা বাঁকা রুক্মিণীর হাসি। বোঝা যায়, সরসী অতি কষ্টে ধৈর্য ধরিয়া আছে।
রুক্মিণী বলে, যেমন ধরুন, যাকে পছন্দ করে তার বাড়ি লোকে না ডাকতেই যায়। যাকে পছন্দ করে না যাওয়ার কথা থাকলে তার বাড়িতেও ভদ্রতার খাতিরে যায়। যাকে অপছন্দ করে তার বাড়িতে যাওয়ার সব ঠিক থাকলেও যায় না।
তাই বটে। রুক্মিণী একদিন তাকে বাড়িতে যাওয়ার নিমন্ত্ৰণ করিয়াছিল, সেও যাইবে বলিয়াছিল। কবে কটার সময় যাইবে তাও ঠিক ছিল। তারপর রুক্মিণীর অস্তিত্বই সে ভুলিয়া গিয়াছিল। না যাওয়ার অজুহাত দিয়া ক্ষমা চাহিয়া একখানা চিঠি পর্যন্ত লেখে নাই। রুক্মিণী আহত হইয়াছে, রাগ করিয়াছে। রাগ করার কথাই।
রাজকুমারের বিপদের টের পাইয়া সরসী মুখ খোলে।
কেন রাজকুমারের চিঠি পাও নি তুমি?
রুক্মিণী বলে, চিঠি? কিসের চিঠি?
রাজকুমার ভাবে, চিঠি? কিসের চিঠি?
সরসী বলে, আমার সামনে ও যে তোমায় চিঠি লিখল? হঠাৎ শিলং যেতে হল ওকে, নিজেই বলতে যাচ্ছিল তোমাকে, আমি বললাম চিঠি লিখে দিলে চলবে। চিঠি পোস্ট করেছিলে তো রাজকুমার?
রাজকুমার বলে, নিশ্চয়।
সরসী বলে, চিঠির কোনো গোলমাল হয়েছিল বোধহয়। পোস্টাপিসের ব্যাপার তো।
পোস্টাপিসের ঘাড়ে সব দোষ চাপাইয়া সরসী ব্যাপারটা শেষ করিয়া দেয়। রুক্মিণী নরম হইলেও এত সহজে রাজকুমারকে রেহাই দিতে পারে না।
শিলং থেকে ফিরে একদিন আসতে পারতেন তো?
এবার আত্মরক্ষার দায়িত্ব রাজকুমারের, সে দুঃখের ভান করিয়া বলে, এমন ব্যস্ত ছিলাম, কি। বলব আপনাকে। তা ছাড়া হঠাৎ গিয়ে আপনাকে বিরক্ত করতেও ভরসা পাইনে।
আচ্ছা, এবার হঠাৎ গিয়ে আমায় বিরক্ত করার নেমন্তন্ন করে রাখলাম। ভুলবেন না যেন। বলিয়া রুক্মিণী এতক্ষণ পরে ক্ষমার সহজ হাসি হাসিল। অর্থহীন দীর্ঘ ভূমিকার পর।