জীবনে আর কোনো মেয়ের কাছে এ দাবি সে করিবে না।
এক কাপ চা আনিয়া কালী বলে, এখন চা খেলে ভাত খাবেন কখন? খিদে নষ্ট হয়ে যাবে।
খিদে থাকলে তো নষ্ট হবে।
খিদে নেই কেন?
ধর খেয়ে এসেছি?
ধর খেয়ে এসেছি মানে? খেয়ে এলে খেয়ে এসেছেন, নয়তো খেয়ে আসেন নি। কোথায় খেলেন? কি খেলেন?
রাজকুমার মুখ গম্ভীর করিয়া বলে, একটা মেয়ে খাইয়ে দিয়েছে কালী। এত খাইয়েছে কি বলব। পেট ভরে বুক ভরে মাথা পর্যন্ত ভরে গেছে।
মাথা ধরেছে?-শঙ্কিতভাবে কালী প্রশ্ন করে।
ধরে নি, ভরেছে।
রাজকুমারের হাসির জবাবে কালী কিন্তু হাসে না। মুখ ভার করিয়া বলে, আপনার শুধু মেয়ে বন্ধু, গণ্ডা গণ্ডা মেয়ে বন্ধু। বেটাছেলের মেয়ে বন্ধু থাকতে নেই।
তাহলে তো তোমার সঙ্গে আড়ি করতে হয়।
আমি তো বন্ধু নই। আমি অনেক ছোট।
ওরাও বন্ধু নয় কালী। ওরা আমার চেয়ে অনেক ছোট–ছেলেমানুষ।
ছেলেমানুষ! কালী অদ্ভুত অবজ্ঞার হাসি হাসে, ধেড়ে ছেড়ে সব মেয়ে, বিয়ে হলে এ্যাদ্দিন–
সাত ছেলের মা হত, না?
কালী সায় দিয়া বলে, বিয়ে হয় নি কেন ওদের? পাত্র জোটে নি?
নাঃ, কই আর জুটল? আমি একবার বলেছিলাম ওদের, এস তোমাদের সবাইকে আমি বিয়ে করছি। ওরা রাজি হয়ে গেল। কিন্তু ধেড়ে ধেড়ে মেয়ে তো সব, ভারি চালাক। প্রত্যেকে বলতে লাগল, আমায় আগে বিয়ে কর, তারপর আর সবাইকে বিয়ে করবে। তার মানে বুঝতে পারছ?
খুব পারছি। একবার বিয়েটা হয়ে গেলে অন্য কাউকে বিয়ে করতে দেবে না, একা বৌ হয়ে থাকবে। আমি তো মেয়ে, মেয়েদের ব্যাপার আমি সব জানি।
রাজকুমারও ক্ৰমে ক্ৰমে সেটা জানিতে পারিয়া আশ্চর্য হইয়া যাইতেছিল। আজকাল কালীর মুখ ফুটিয়াছে। রাজকুমারের সঙ্গে হালকা অথবা ভারি চালে সে অনর্গল আলাপ করিয়া যায়। অভিজ্ঞতার অভাব আছে কিন্তু সাংসারিক বিষয়ে জ্ঞানের তার অভাব আছে বলিয়া মনে হয় না। কিন্তু তবু তার যে সরলতা মুগ্ধ করে, সেটা ভান নয়, মুগ্ধ করার ক্ষমতাই তার সব চেয়ে বড় প্রমাণ। রিণি মালতী সরসীর চেয়ে কালী বোকা নয়! কালীও সব বিষয়ে ওদের মতো। ওদের সঙ্গে কালীর তফাত দুপুরের রোদের সঙ্গে সকালের রোদের তফাতের মতো।
সহজভাবে নিশ্চিন্ত মনে কালীর সঙ্গে কথা বলা যায়। এভাবে কারো সঙ্গে কথা বলিবার। সুখটা রাজকুমারের এতদিন জানা ছিল না। কথা বলার আগে কিছু ভাবিতে হয় না, ভাবিবার সময় কথা বলিয়া যাইতে হয় না। যতক্ষণ খুশি কথা বল, এক মিনিট অথবা এক ঘণ্টা। কথা বলতে চাও বল, কথা শুনতে চাও শোন, নয়তো খুশিমতো চুপ করিয়া থাক, বধির হইয়া যাও। সবই স্বাভাবিক, কেউ রাগ করিবে না। বলার কথাও খুঁজিতে হয় না। রিণি-মালতী-সরসীর সঙ্গে কথা বলার সময় কতবার বলার কথা না থাকায় অস্বস্তি বোধ করিতে হইয়াছে, টানিয়া আনিতে হইয়াছে সাহিত্য, দর্শন, রাজনীতি অথবা চেনা মানুষের সমালোচনা। ছেলেমানুষি আবোল তাবোল কথা শুধু কালীর সঙ্গে বলা যায়।
মনোরমা হেঁসেল আগলাইয়া বসিয়া থাকে, ঘরে দুজনের গল্প চলে। দাঁড়াইয়া দাঁড়াইয়া পায়ে ব্যথা ধরিয়া গেলে কালী কোণের টুলটা কাছে আনিয়া বসে। কালীর প্রসাধনের গন্ধটি তেজী ও স্পষ্ট। রিণি-মালতী-সরসীর মতো কেবল সুবাসের মৃদু ইঙ্গিত নয়।
হঠাৎ এক সময় মনোরমার এদিকে ভয় হয়। এত দেরি? রাজকুমারের সম্বন্ধে ভাবনার কিছু নাই বটে, তবু এত দেরি? বিবাহের আগে শুধু একদিন একজনের সঙ্গে মনোরমা আধ ঘণ্টা নির্জনে গল্প করিয়াছিল। কেউ বাধা দিয়া গল্পের সমাপ্তি ঘটায় নাই, বাধা সে দিয়াছিল নিজেই, নিজেকে বাঁচানোর জন্য। ভাবিছিল, তাই উচিত। দুদিন পরে যার সঙ্গে বিবাহ হইবে, এখন তার কাছে ধরা না দেওয়াটাই নিয়ম। আজ অসময়। কিন্তু আর তো আসিল না সে মানুষটি। মনোরমা জানে, সেদিন ধরা দিলে সে আসিত। দুদিনের জন্য নয় চিরদিনের জন্য। সে তো বুঝিতে পারে নাই। মনোরমার মনের কথা, হাত ধরামাত্র তার রক্তেও কি আগুন লাগিয়াছিল–আজো তার তাপে মনোরমার মন জ্বলিয়া যায়। সে ভাবিয়াছিল, মনোরমা বুঝি ঠাণ্ডা, মন তার বরফের দেশ। কল্পনার শীতল মনোরমা তার ভালবাসাকে জুড়াইয়া দিয়াছিল। তাছাড়া আর কি কারণ থাকতে পারে তার না আসার, মনোরমাকে বিবাহ না করার?
সাড়ে নটার সময় কালী চা দিতে গিয়াছে, সাড়ে দশটা বাজিয়া গেল। মনোরমার বুক ঢিপঢ়িপ করে। এত দেরি। খাইতে আসার তাগিদ দিতে রাজকুমারকে ডাকিতে গিয়া কালীকে বাঁচানোর জন্য মনটা ছটফট করে মনোরমার। কিন্তু সে উঠিতে পারে না। শুধু আজের জন্য বচাইতে গিয়া সে যদি কালীর চিরদিনের মরার ব্যবস্থা করিয়া বসে?
তারপর কালীর তীক্ষ্ণ হাসির শব্দ কানে আসে। মনোরমা জোরে নিশ্বাস ফেলে। সর্বাঙ্গে তার কয়েকবার শিহরণ বহিয়া যায়। পিঁড়িটা ঠেলিয়া দেয়ালের কাছে গিয়া ঠেস্ দিয়া বসিয়া সে চোখ বোজে! হাসি! আর ভয় নাই। যেখানে হাসি আছে সেখানে কোনো ভয় নাই।
রাজকুমার একদিন সন্ধ্যার পর মালতীর খোঁজ করিতে গেল। এতটুকু পথ যাইতেই চোখে পড়িল আলো আর দেবদারু পাতায় সাজানো তিনটি বাড়ি। ছাতে সামিয়ানা, সানাই বাজিতেছে। অগ্রহায়ণ মাস, চারিদিকে বিয়ের ছড়াছড়ি। রাজকুমারের মনে পড়ে, একটি বন্ধুর বিবাহে তার নিমন্ত্রণ ছিল। দুটি বছর খুঁজিয়া বাছিয়া একটি মেয়ে পাওয়া গিয়াছে পছন্দমতো। এ পছন্দের মানে রাজকুমার জানে। মেয়েটি সুন্দরী নয়, রং খুব ফর্সা। তার আরেকটি বন্ধু এরকম বাছাই করা এক মেয়েকে বিবাহ করিয়াছে। অমন রূপ নাকি খুব কম দেখা যায়। বৌ দেখিয়া তাকে নিজের বৌ হিসাবে কল্পনা করিতে গিয়া রাজকুমার শিহরিয়া উঠিয়াছিল, এমন কুৎসিত ছিল সেই অত্যন্ত ফর্সা রঙের মেয়েটি।