না, আগেই শুনে যাও।
বেশিক্ষণ লাগবে না নাইতে। মিনিট কুড়ি। কথাটা ততক্ষণ মনে মনে গুছিয়ে নাও বরং, বলতে সুবিধে হবে।
রিণি একটু হাসিল। এমন মধুর হাসি রাজকুমার কোনোদিন তার মুখে দ্যাখে নাই। রিণি যেন। হঠাৎ আজ কেমন হইয়া গিয়াছে।
তবে আজ থাক, রিণি।
থাকবে কেন? তোমার আজ কি হয়েছে বল তো? খেলে এসে না নাওয়া পর্যন্ত আমার কি বিশ্রী লাগে তুমি বুঝবে না। বলতে চাও বলো, শুনতে কিন্তু আমার ভালো লাগবে না বলে রাখছি।
কথাটা শোন আগে, বুঝতে পারবে নাইতে যাওয়ার আগে কেন বলতে চাই। আমি বাথরুমে থাকব, রিণি।
বাথরুমে থাকবে?
তোমার নাওয়া দেখব। তুমি নাইবে, আমি এক কোণে দাঁড়িয়ে থাকব চুপ করে।
রিণি কথা বলতে পারে না। জোরে তার দাতে সঁত আটকাইয়া গিয়াছে, মুখ দেখিলেই বোঝা যায়। রাজকুমার সোজা তার চোখের দিকে তাকায় দ্বিধা সঙ্কোচ ভয় সব তার এতক্ষণে কাটিয়া গিয়াছে।
কথাটা তোমার খুব অন্যায় মনে হচ্ছে? এখানে বোলোঁ, আমি তোমায় সব বুঝিয়ে বলছি।
বুঝিয়ে বলতে হবে না। আমি বুঝেছি। কোথায় গিয়েছিলে বাবার সঙ্গে? কটা পেগ গিলেছ?
পেগ? ওসব আমার নেই তুমি জান না?
এতদিন তাই তো জানতাম।
আজ আমার কথা শুনে ধারণাটা বদলে গেছে, না? আমার সব কথা কিন্তু শোন নি রিণি।
হাত ধরিয়া রিণিকে একরকম সে জোর করিয়া একটা সোফায় বসাইয়া দিল। বড় রাগ হইতেছিল রাজকুমারের। এত কথা ভাবিবার থাকিতে রিণি কিনা ভাবিয়া বসিল মদ গিলিয়া সে তার সঙ্গে ফাজলামি করিতে আসিয়াছে!
আগ্রহের সঙ্গে সে রিণিকে সব বুঝাইয়া দিতে থাকে। বিশেষ করিয়া জোর দেয় তার নিস্পাপ। নির্বিকার মনোভাবের উপর, তার উদ্দেশ্যের আসল মানের উপর। কি আবেগের সঙ্গেই সে যে বার বার ঘোষণা করে, বাথরুমে রিণিকে দেখিতে যাওয়ার মতো অভদ্র ছোটলোক সে নয়, ওরকম ইচ্ছা জাগার মতো হীন নয় তার মন।
ব্যাখ্যা করিতে রাজকুমার চিরদিনই ওস্তাদ। বুঝিতে রিণির আর কিছুই বাকি থাকে না। মুখের ভাবে তার পরিবর্তন কিন্তু হয় আশ্চর্য রকম, রাজকুমারের সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত। মনে হয়, রাজকুমারের প্রস্তাব শুনিয়া তার যেন শুধু চমক লাগিয়াছিল, রাজকুমার মদ খাইয়া আসিয়াছে ভাবিয়া তার যেন দুঃখ হইয়াছিল। এতক্ষণে তার রাগ হইয়াছে, ব্যাখ্যা শুনিবার পর, সব বুঝিবার পর।
বুঝতে পেরেছ রিণি?
পেরেছি বৈকি।
গলার আওয়াজেই রাজকুমার সচেতন হইয়া উঠিল। তীক্ষ্ণ সুরকে চাপিয়া এভাবে দাঁতে কাটিয়া রিণিকে সে আর একদিন কথা বলিতে শুনিয়াছিল। গানের আবেশে বিহ্বলা রিণির বাড়ানো মুখের আমন্ত্রণ যেদিন সে গ্রহণ করে নাই। সেদিনও রিণির নাক এমন ফুলিয়া উঠিয়াছিল। মুখ দেখিয়া মনে হইয়াছিল রাগের মাথায় হঠাৎ বুঝি কামড়াইয়া দিবে দুরন্ত ছোট মেয়েরা যেমন দেয়।
ম্লান মুখে রাজকুমার একটু হাসিল।
জিজ্ঞেস করে লাভ নেই, তুমি রাজি নও বুঝতে পারছি।
বুঝবে বৈকি। তুমি তো বোকা নও।
কিছু মনে কোরো না রিণি।
না। মনে আবার কি করব।
আমি তবে যাই।
যাও। আর এস না।
আচ্ছা।
রাজকুমার উঠিয়া দাঁড়াইল।
কথাটা তুমি আর একটু উদারভাবে নেবে ভেবেছিলাম, রিণি।
রিণিও উঠিয়া দাঁড়াইল।
তোমায় বোকা ভাবতে পারলে তাই নিতাম। তুমি তো বোকা নও।
রাজকুমার চলিয়া যায়, রিণি পিছন হইতে তাকে ডাকিল।
একটা উপদেশ নিয়ে যাও। আরেকটি মেয়েকে যখন কথাটা বলবে, মালতীকেই বলবে বোধহয়, কিছু বুঝিয়ে বলতে যেও না। শুধু বোলো যে তোমার এ সাধটা না মেটালে তুমি পাগল হয়ে যাবে, সায়ানাইড খাবে। হয়তো রাজি হতে পারে।
রিণি কিছুই অস্পষ্ট রাখে নাই। কয়েকটি কথাতেই সব পরিষ্কার বুঝাইয়া দিয়াছে। যতই অসঙ্গত হোক, শুধু তার ইচ্ছার কথা হইলে নিজের নিরাবরণ দেহটি তাকে দেখাইতে রিণি রাজি হইলেও হইতে পারিত। সত্য সত্যই রাজি সে হয়তো হইত না, কিন্তু একটু দোমনা তো অন্তত হইত। একবারের জন্যও মনে তো হইত কি আসিয়া যায় মানুষটার ব্যাকুল প্রার্থনা মিটাইলে? বিমুখ করিয়া একটু আফসোসও হয়তো জাগিত। নিজের জন্য আবেদন জানানো ছাড়া রিণির মন একটু নরম করারও আর কোনো উপায় নাই। কেবল রিণির নয়, সব মেয়ের সম্বন্ধেই এই এক কথা। রিণি তাই বলিয়াছে।
রাজকুমার কি কথাটা জানে না? যুক্তির দাম মেয়েদের কাছে নাই, একটুখানি আবেগের বন্যায় বিশ্বের সমস্ত যুক্তি তর্ক উচিত অনুচিত ভালো মন্দ ভাসিয়া যাইতে পারে, এটুকু জ্ঞান কি সে সঞ্চয় করিতে পারে নাই এত দিনে? রাজকুমার লজ্জা বোধ করে। রিণি তাকে বোকা মনে করিতে অস্বীকার করিয়াছে, বোকামি কিন্তু সে করিয়াছে সত্যই। সায়ানাইড খাওয়ার কথা বলিলে রিণি গর্ব বোধ করিবে আর নিছক একটা থিয়োরি যাচাই করিতে তার সাহায্য চাহিলে সে বোধ করিবে অপমান, এটুকু তার খেয়াল রাখা উচিত ছিল।
তাছাড়া, রিণি প্রত্যাশা করিয়াছিল অন্য কথা। রাজকুমার বিশ্বাস করে না রিণি তাকে ভালবাসে। তাতে কিছু আসিয়া যায় না। ভালো না বাসিলেও ভালবাসার ঘোষণা শুনিতে কে না। ভালবাসে? এদিকটাও তার খেয়াল করা উচিত ছিল।
নিজের চারকোনা ঘরে চারকোনা খাটে রাজকুমার চিৎ হইয়া পড়িয়া থাকে আর উত্তেজিত চিন্তায় ছোটাছুটি করে তার মন। সিলিঙের হাত তিনেক নিচে একটা মাড়সা শূন্যে ঝুলিয়া আছে, সূক্ষ্ম অবলম্বনটি চোখে পড়ে না। কিছুক্ষণ নিশ্চেষ্ট থাকিয়া উপরে উঠিতে আরম্ভ করিয়া মাকড়সাটি আরো হাতখানেক নিচে পড়িয়া যায়। রাজকুমারের ঠোঁটে হাসি ফুটিয়া ওঠে। না, দ্বিতীয় বার চেষ্টা করার চেয়ে তার ব্যর্থতাই ভালো।