রাজকুমারের যেন ধাঁধা লাগিয়া যায়।
রিণির সাহস আছে, একগুঁয়েমি আছে, তেজ আছে। এইগুলি সে অৰ্জন করিয়াছে তার আত্মবিরোধী জীবন যাপনের প্রক্রিয়ায়। রিণিকে সে যদি তার নূতন চিন্তাধারার সন্ধান দেয়? রিণির কাছে সে যদি তার অসঙ্গত দাবি জানায়?
স্যার কে. এল-এর একটা কথাও রাজকুমারের কানে যায় না, নিজে সে কি বলিতেছে আর রিণি কি জবাব দিতেছে তাও ভালো খেয়াল থাকে না।
কথা বন্ধ করিয়া হঠাৎ সে গম্ভীর হইয়া যায়।
শান্ত মনে কথাটা বিবেচনা করা দরকার। রিণিকে কিছু বলা না বলার উপর অনেক কিছু নির্ভর করিতেছে, কেঁকের মাথায় কিছু করিয়া বসিলে চলিবে না। রিণি রাগ করিতে পারে, চিরদিনের জন্য তার সঙ্গে সব সম্পর্ক তুলিয়া দিতে পারে, মনে মনে তাকে ঘৃণা করিতে পারে, দুঃখ পাইতে পারে, হাসিয়া উড়াইয়া দিতে পারে। অনেক রকম সম্ভাবনাই আছে। ভালো করিয়া ভাবিয়া দেখা দরকার।
কিন্তু অনুরোধটা জানাইলে রিণির কাছে কি রকম প্রতিক্রিয়া আশা করা উচিত সে বিষয়ে তাকে ভাবিতে হইতেছে কেন? ঠিক কি রকম প্রতিক্রিয়া হইবে এতদিন রিণিকে জানিয়া এটুকুও সে কি অনুমান করিতে পারে না?
রিণি বাড়ির মধ্যে চলিয়া যাইতেছিল, রাজকুমার তাড়াতাড়ি গিয়া বলিল, তোমার সঙ্গে আমার একটা কথা আছে রিণি। খুব দরকারি কথা।
রিণি আশ্চর্য হয় না। কোথাও কিছু নাই, হঠাৎ খাপছাড়া উত্তেজনার সঙ্গে খুব দরকারি একটা কথা বলিতে চাওয়া, রিণি তার মানে জানে। ঠিক এমনিভাবে ওরা চিরদিন কথাটা জানায়। বলার সুযোগ যখন থাকে তখন কিছু বলে না, আজকালের মধ্যে আবার সুযোগ আসিবে জানিয়াও অপেক্ষা করিতে পারে না, অসময়ে ব্যস্ত হইয়া ওঠে।
কি কথা?
ঘরে চল, বলছি।
দু-চার মিনিটে বলা হবে না বোধহয়?
না। একটু সময় লাগবে। অনেক কথা বুঝিয়ে বলতে হবে তোমাকে।
আমারও বুঝতে সময় লাগবে নিশ্চয়। মালতীর মতো বুদ্ধি তো নেই।
রিণির এই ঈর্ষার খোঁচাটা রাজকুমারকে তিরস্কারের মতো আঘাত করিল। মালতীর কথা তার মনেই ছিল না। নূতন চিন্তাটাই কিছুদিন হইতে তার মন জুড়িয়া আছে। মালতী নামে যে একটি মেয়ে আছে জগতে, গত বর্ষার এক সন্ধ্যায় ওই মেয়েটিকে যে জগতের অন্য সব মেয়ের চেয়ে সে কাছে আসিতে দিয়াছে, এসব সে যেন ভুলিয়াই গিয়াছিল।
মালতীকে সে আর পড়ায় না। এবার মালতীর পরীক্ষা, ভালোভাবে পাস করার আগ্রহ তার চিরদিন খুব প্রবল। রাজকুমারের কাছে পড়িলে তার আর পাস করার ভরসা নাই। রাজকুমার তাই নিজেই পড়ানো বন্ধ করিয়া দিয়াছে। মালতীও আপত্তি করে নাই। তার আসা-যাওয়া যে একেবারে কমিয়া গিয়াছে, বাদ পড়িয়াছে অতি প্রয়োজনীয় অনাবশ্যক কথা বলা, সেজন্যও মালতীর কাছ। হইতে কোনো নালিশ আসে নাই। হয়তো মালতী ভাবিয়াছে পড়াশোনার ব্যাঘাত ঘটানোর ভয়ে সে যায় না, পরীক্ষার আগে আবেগ ও উত্তেজনায় তাকে একটি দিনের জন্যও অশান্ত করিতে চায় না। ভাবিয়া মালতী হয়তো কৃতজ্ঞতাই বোধ করিতেছে।
তার ব্যবহারে মালতী দুঃখ পায় নাই–এই যুক্তি কিন্তু রাজকুমারের নিজের মানসিক শান্তি বজায় রাখতে কাজে লাগে না। শ্যামলের কথাটা তার মনে পড়িয়া যায়। শ্যামল বলিয়াছিল, মালতীকে ভালবাসিবার উপযুক্ত সে নয়। অসঙ্গত বলিয়া জানিলেও কথাটা এখন তাকে পীড়ন করিতে থাকে। রিণির কাছে যে প্রস্তাব করিতে সে চাহিতেছে, জানিতে পারিলে মালতী ব্যথা পাইবে। সে ব্যথার স্বাদ কতকটু, কত তীব্র তার জ্বালা, রাজকুমার অনুমান করিতে পারে। মালতী তার উদ্দেশ্য বুঝিবে না। রিণির রূপ যে সে দেখিতে চায় না, রিণিকে অনুরোধটা জানানোর আগে তার হৃৎস্পন্দন দ্রুত হওয়া আর গলা শুকাইয়া যাওয়ার কারণ যে মনের কোনো দুর্বলতা নয়, মালতী তা ধারণাও করিতে পারিবে না, বিশ্বাসও করিবে না! মালতীর কাছে সে উদারতা প্রত্যাশাও করা চলে না। আহত-বিস্ময়ে কত কি যে মালতী ভাবিবে! ক্ষোভ, দুঃখ, ঈর্ষা ও ক্রোধে আরো কত আঘাত যে নিজের জন্য নিজেই সে চয়ন করিবে।
তবে, হয়তো মালতী জানিবে না। না জানার সম্ভাবনাই বেশি। রিণি যদি রাগ করে, চিরদিনের জন্য যদি তার সঙ্গে সম্পর্ক চুকাইয়া দেয়, কারো কাছে সে কোনোদিন বলতে পারিবে না, ছদ্মবেশী এক বুনো জানোয়ারের কোন দাবি একদিন তাকে প্রত্যাখ্যান করিতে হইয়াছিল।
মালতী জানিবে না। তবু রাজকুমার অস্বস্তি বোধ করিতে থাকে। স্তরে স্তরে সঞ্চিত সংস্কারের অবাধ্য প্রতিবাদ একটানা চাপের মতো মনে অশান্তি জাগাইয়া রাখে। মালতীর না জানা তো বড় কথা নয়! মালতীর জানার ফলাফলটা সে যতখানি কল্পনা করিতে পারে তারই গুরুত্ব যেন সকলের আগে বিবেচ্য। জানুক বা না জানুক, আঘাত পাক বা না পাক, যে কাজ করিলে একটি মেয়ের সুখ-শান্তি ধ্বংস হইয়া যাওয়ার সম্ভাবনা আছে, সে কাজ করা তার উচিত নয়। মনে তার পাপ নাই?—না থাক। পুণ্যের জন্যও অনেক কাজ সংসারে করা যায় না।
রিণির সঙ্গে গুরুতর বোঝাপড়ার লড়াই শুরু করিবার ঠিক আগে এসব চিন্তা রাজকুমারকে একটু কাবু করিয়াছিল বৈকি। কালও যা করা চলিবে আজ তা না করিয়া পালানোর কথাটাও একবার তবু মনে আসিল। ভাবিয়া চিন্তিয়া দেখিবার জন্য আরেকটু সময় নিলে কি আসিয়া যায়? হঠাৎ যেন একটু ভয় করিতে লাগিল রাজকুমারের। ভাবনা তার ছিল অনেক, এতক্ষণ ভয়। এতটুকু ছিল না।
সময় যদি লাগে, তাহলে তুমি বোসো। নেয়ে এসে তোমার দরকারি কথা শুনব।