তাই নাকি?
তাই। বিজ্ঞানের এত উন্নতি কেন সম্ভব হয়েছে জান? জগতের সর্বশ্রেষ্ঠ বৈজ্ঞানিকের কথাও কেউ বিশ্বাস করতে পারে না, এই নিয়ম মেনে চলা হয়েছে বলে। সামান্য একটি আবিষ্কার পর্যন্ত তাকে প্রমাণ করতে হবে আগে শ খানেক আবিষ্কারের মানুষকে চমকে দিয়েছে বলেই যে তার এক শ এক নম্বর আবিষ্কারটি মেনে নেওয়া হবে, তা চলবে না। অনুমান করার অধিকার আছে কিন্তু সেটা অনুমান বলেই ঘোষণা করতে হবে। আমি বলছি বলে কোনো কথা বিজ্ঞানে নেই।
সত্যি, ভারি আশ্চর্য তো!
রাজকুমার মনে মনে হাসে। ঠিক এই প্রতিক্রিয়াই পরেশের কাছে প্রত্যাশা করা চলে। অকৰ্মণ্য অলস মানুষের স্থিতিশীল অকৰ্মণ্যতার এও একটা প্রমাণ। যা ভাবে না, যা জানে না, অন্যের কাছে তার ব্যাখ্যা শুনিতে এরা জ্বালা বোধ করে। মনে করে তারই যেন সমালোচনা করিতেছে, উপদেশ দিয়া প্ৰমাণ করিতেছে, তারই মূখতা।
আশ্চর্য বৈকি, গাম্ভীর্যের ভান বজায় রাখিয়াই রাজকুমার বলিয়া যায়, আমি যে দেহ দেখে মানুষকে জানার কথা বলছিলাম তাও কতকটা হাত দেখার মতো। মানুষকে দেখে অনেক সময় তার স্বভাব-চরিত্র টের পাওয়া যায় মান তো?
কে জানে, জানি না।
যেমন ধর সুরেশ। দেখলেই টের পাওয়া যায় ছেলেটা বিগড়ে গেছে। অনায়াসে বলা যায় ছেলেটা লেখাপড়াও শিখবে না, মানুষও হবে না। যেখানে ওকে তুমি রাখ, যে কাজেই লাগিয়ে দাও, ও কখনো ভালোভাবে চলতে পারবে না।
সুরেশ পরেশের ছোট ভাই কদিন আগে অতি কুৎসিত একটা অপরাধে ছমাসের জন্য জেলে গিয়াছে। সুরেশের পাংশু শীর্ণ মুখে সদা চঞ্চল কুটিল দুটি চোখ দেখিলে অপরিচিত মানুষও সত্যসত্যই টের পাইয়া যাইত তার ভিতরটা কি রকম বিকারে ভরা।
পরেশ মুখ অন্ধকার করিয়া উঠিয়া দাঁড়ায়।
একটা রোগী দেখতে যাব। বলিয়া সে চলিয়া যায় বাড়ির ভিতর।
তখন সন্ধ্যা পার হইয়া গিয়াছে। পথে চলিতে চলিতে রাজকুমারের মনে হয় পরেশকে না। চটাইলেই হইত। এরকম সস্তা অভিমান দেখিলেই কেন যে তার আঘাত দিতে ইচ্ছা হয়! ছেলেবেলা ফাপানো খেলনা বেলুন দেখিলেই যেমন ফুটা না করিয়া থাকিতে পারি না, এখন ফ্ৰকা মানুষের সংস্পর্শে আসিলেই ফাঁকিতে খোঁচা দেওয়ার সাধটা তেমনি সে দমন করিতে পারে না। মানুষের সঙ্গে এই জন্য তার বনে না। আবেগ আর অভিমানে সায় দেওয়ার তোষামোদ জানে না বলিয়া আত্মীয় বন্ধু অনেকের কাছেই সে পছন্দসই লোক নয়। দশজনের সঙ্গে খাপ খাইয়া চলার প্রধান মন্ত্রটিই সে বাতিল করিয়া রাখে।
ভাবিতে ভাবিতে গভীর একাকিত্বের অনুভূতি তাকে বিশ্ন করিয়া দেয়। মানুষের সঙ্গ লাভের এমন একটা জোরালো কামনা সে অনুভব করে যেন বহুদিন অরণ্যে বা প্রান্তরে বাস করিতেছে। ক্লাবের কথা মনে পড়ায় তাড়াতাড়ি সে সেখানে গিয়া হাজির হয়। টেনিস খেলার শখ জাগায় একদিন সে ক্লাবে যোগ দিয়াছিল, তারপর নিয়মিত চাঁদা দিয়া আসিতেছে কিন্তু ক্লাবে যাতায়াত করে কদাচিৎ। এই ব্যাপারটা আজ যেন তার খেয়াল হইল প্রথম। ক্লাবের সে মেম্বার, ক্লাবে সুযোগ আছে খেলাধুলা ও দশজনের সঙ্গে মেলামেশা করার, কিন্তু ক্লাবের জন্য কোনো আকর্ষণ সে অনুভব করে না। মানুষের সঙ্গ সে কি ভালবাসে না? মানুষটা সে কি কুনো? অথবা দশজনের সঙ্গে মানাইয়া চলিতে পারে না বলিয়া দশজনকে এড়াইয়া চলে?
স্যার কে. এল প্রায়ই ক্লাবে বিলিয়ার্ড খেলিতে আসেন। তিনজন অর্ধ-পরিচিতের সঙ্গে ব্রিজ খেলিতে বসিয়া রাত নটার সময় বিরক্তিতে রাজকুমারের চোখে যখন প্রায় জল আসিয়া পড়ার উপক্ৰম করিয়াছে, স্যার কে. এল-ই তাকে উদ্ধার করিলেন।
গাড়িতে উঠিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, হঠাৎ তুমি আজ এদিকে?
রাজকুমার বলিল, আড্ডা দিতে এসেছিলাম। কিন্তু আজ্ঞা আমার একেবারে সয় না।
আমারও সয় না। তবু আড্ডা দিই।
পথে স্যার কে. এল-এর এক বন্ধুর বাড়ি হইতে রিণিকে তুলিয়া নেওয়ার কথা ছিল। রিণি এখানে প্রায়ই রাত্রে টেনিস খেলিতে আসে। বিকালে সে খেলে না। খেলার পর যে শ্রান্তি বোধ হয় তাতে নাকি বিকালটা তার মাটি হইয়া যায়। রিণির দেখাদেখি আরো কয়েকটি ছেলেমেয়ে নাকি বিকালের বদলে রাত্রে টেনিস খেলার সুবিধা বুঝিতে পারিয়াছে।
তখনো খেলা চলিতেছে। সর্ট আর শার্ট পরা রিণিকে যে সে দেখিতে পাইবে রাজকুমার তা কল্পনাও করে নাই। জোরালো কৃত্রিম আলোয় রিণির দ্রুত সঞ্চরণশীল হালকা শরীরটি তার চোখে যেন নতুন একটা বিস্ময়ের মতো ঠেকিতে লাগিল। প্রতিপক্ষ দলের মেয়েটি শাড়ি পরিয়াই খেলিতে নামিয়াছে, মাঝে মাঝে রিণির দিকে চাহিয়া তার ঠোঁটে ফুটিয়া উঠিতেছে। মৃদু হাসি।
খেলা দেখার জন্য দাঁড়াইয়া রাজকুমার শেষ পর্যন্ত দেখিয়া গেল শুধু রিণিকে।
খেলার শেষে রিণি বলিল, আরেকটু শীত না পড়লে খেলে আরাম নেই। যত শীত পড়ে তত তাড়াতাড়ি ঘাম শুকিয়ে যায়।
রাজকুমার বলিল, খেললে ঘাম হয় না।
ফ্যাট হয় না। আর রাত্রে ভালো ঘুম হয়। বাড়ি গিয়ে স্নান করলেই ঘুমে চোখ জড়িয়ে আসবে।
শরীর সম্বন্ধে রিণির যে এতখানি যত্ন আছে রাজকুমারের জানা ছিল না। স্যার কে. এল-এর জন্য আজ গাড়িতে রিণির পাশে বসিতে না পারায় তার কেমন যেন ক্ষতি বোধ হইতে থাকে। রিণির গলা পর্যন্ত এখন ঢাকা, মুখ ফিরাইয়া কথা বলিতে গিয়া সে আবরণ সে যেন দেখিতে পায়। না, টেনিস কোর্টের রিণিই যেন এত কাছে পিছনের সিটে বসিয়াছে মনে হয়। এই দেহাশ্রয়ী জীবটি আহলাদী মেয়ের মতো আদরের তাপে গলিতে চায়, শান্ত সুরক্ষিত সংস্কারময় অন্তঃপুরে স্বামী নামে প্রভুর তত্ত্বাবধানে বাস করিবার শুধু সে উপযোগী এই সিদ্ধান্ত কি সে করিয়াছে এই রিণির সম্বন্ধে?