মোটা মোটা ডাক্তারি বই আর নোটবুকগুলির পাতা উল্টাইতে উল্টাইতে এই কথাটা সে মনে মনে নাড়াচাড়া করে। পরীক্ষার জন্য দেহ ভাড়া করা যায়, কিন্তু সে সব নরনারীর দেহ পরীক্ষা করিয়া তার বিশেষ কোনো লাভ হইবে না। যাদের সে জানে, যাদের সুখ-দুঃখ-আশা-আকাঙ্ক্ষার সংবাদের সঙ্গে জীবনযাপনের রীতিনীতির পরিচয় সে রাখে, নিরাবরণ তাদের কয়েক জনকে সে যদি দেখিতে পাইত!
কিন্তু এদের কারো কাছে ইচ্ছাটা জানানো পর্যন্ত চলে না।
শোনামাত্র যুগ-যুগান্তরের সংস্কারে ঘা লাগিবে, তাকে মনে করিবে পাগল, অসভ্য, বর্বর। বুঝাইয়া বলিলে যে কেউ বুঝিবে সে ভরসাও রাজকুমারের নাই।
সে যে শুধু একটা সত্যের, একটা নিয়মের সন্ধান চায়, কেউ তা বিশ্বাস করিবে না। যতই ভীরু আর লাজুক মনে হহাক, উদ্ধত অত্যাচারী সৈনিক বা যন্ত্রীর জীবন ছাড়া শ্যামলের সুখী হওয়ার উপায় কেন নাই; কঞ্চির মতো যতই অবাধ্য ও স্বাধীন মনে হোক রিণিকে, শাসন-পিপাসু শক্তিমান পুরুষের উপর কলা-বৌয়ের মতো নির্ভর করিতে না পারিলে রিণির জীবনে সাৰ্থকতা কেন নাই; দেশে দেশে নগরে নগরে যাযাবর জীবন কেন স্যার কে. এল-এর প্রয়োজন ছিল; ইতিমধ্যেই চার-পাঁচটি সন্তানের মা হইতে না পারায় সরসী কেন সভা-সমিতি করিয়া বেড়ায়; এসব প্রশ্নের জবাব জানিবার প্রয়োজন কেউ বোধ করে না, কৌতূহলও কারো নাই। এগুলি প্রশ্ন বলিয়াই তারা স্বীকার করিতে চায় কিনা সন্দেহ। মানুষের দেহে এই সব রহস্যের নির্দেশ সন্ধান করা ওদের কাছে অর্থহীন উদ্ভট ব্যাপার, ডি ছি করার ব্যাপার।
কিন্তু যেটুকু সে জানিয়াছে কেবল সেইটুকু জানিয়া থামিয়া থাকার কথা ভাবিলেও এদিকে জীবনটাই যেন অসঙ্গত মনে হয়। কেঁকের এই অভিশাপ চিরকালের যখন যেদিকে গতি, সেদিক ছাড়া অন্য কোনোদিকে জগতের সাৰ্থক অস্তিত্ব আছে ভাবা যায় না।
একদিন আলোচনা ও পরামর্শের জন্য রাজকুমার বিকালবেলা হাজির হয় বন্ধু পরেশের কাছে।
পরেশ বলে, এ্যানাটমি শিখতে চাও? সেটা তো এমন কিছু কঠিন ব্যাপার নয়। আমি সব ব্যবস্থা করে দিতে পারি। ওর আর কি, পয়সা দিয়ে মড়া কিনবে, ছুরি দিয়ে কাটবে
মড়া! জীবনের সঙ্গে সে খুঁজিতেছে জীবন্ত মানুষের সংযোগ ও সামঞ্জস্যের রীতি, মড়া কাটিয়া তার হইবে কি?
উৎসাহের সঙ্গে রাজকুমার পরেশকে ব্যাপারটা বুঝাইয়া বলিতে আরম্ভ করে।
পরেশ ডাক্তার মানুষ, রাজকুমারের কথা শুনিতে শুনিতে সে হাসিতে আরম্ভ করিয়া দেয়।
হাত দেখার ব্যাপারটা জানি, শরীর দেখাটা নতুন ঠেকছে।
তুমি হাত দেখায় বিশ্বাস কর না?
না। ওসব বুজরুকি।
তুমি যা জান না তাই যদি বুজরুকি হয়–
আমি জানি না বলে নয়। একটা কিছু সম্ভবপর কিনা সাধারণ বুদ্ধিতেই মোটামুটি বোঝা যায়। ভবিষ্যৎ কখনো মানুষের হাতে লেখা থাকতে পারে! হাত দেখে কখনো বলা যেতে পারে একদিন মানুষের জীবনে কি ঘটবে না ঘটবে?
নগেনবাবু যে এক বছরের মধ্যে অন্ধ হয়ে যাবেন, তুমি কি করে জানলে?
সেটা ভিন্ন কথা। নগেনবাবুর চোখে অসুখ হয়েছে, চোখের এই অসুখে বছরখানেকের মধ্যে মানুষ অন্ধ হয়ে গেছে।
কয়েকটা চেনা লক্ষণ দেখে তুমি জানতে পেরেছ, নগেনবাবুর চোখে অসুখ হয়েছে, কেমন? আগে আরো অনেকের চোখে এই রকম অসুখ হয়েছে, অল্পদিনের মধ্যে তারা অন্ধ হয়ে গেছে, তুমি তাই বলতে পারছ নগেনবাবুও অন্ধ হয়ে যাবেন। মানুষের হাতেও তো চেনা লক্ষণ থাকতে পারে, যা দেখে এরকম ভবিষ্যদ্বাণী করা চলে? যেমন ধর পরেশের হাত টানিয়া আঙুলগুলির ঠিক নিচে হাতের তালুতে চারটি চিহ্ন দেখাইয়া দেয়, এগুলো দেখে আমি বুঝতে পারছি ডাক্তারিতে তোমার কোনোদিন পসার হবে না।
হাত দেখার বুজরুকির পরেশের হঠাৎ গভীর কৌতূহল দেখা যায়। আগ্রহের সঙ্গে সে জিজ্ঞাসা করে, কি করে জানলে?
আরো অনেকের হাতে এরকম চিহ্ন ছিল, দেখা গেছে তারা খুব ঢিলে অলস প্রকৃতির মানুষ। কোনো বিষয়ে চেষ্টাও থাকে না, পরিশ্রমও করতে পারে না। বছর পাঁচেকের মধ্যে তোমার উন্নতি হওয়া অসম্ভব।
পাঁচ বছর পরে সম্ভব?
তা বলা যায় না। তবে উন্নতি না হওয়ার লিমিট যে পাঁচ বছর সেটা জোর করে বলতে পারি। বাপের পয়সাতেই এ কটা বছর তোমায় চালাতে হবে। অবস্থার ফেরে যদি স্বভাব বদলায়, হাতের এই চিহ্নগুলিও বদলে যাবে, তখন হয়তো তোমার কিছু হতে পারে। বছর পাঁচেক সময় তাতে লাগবেই।
পরেশ মনে মনে চটিয়াছিল, ব্যঙ্গ করিয়া বলিল, তুমি এত বড় গণৎকার হয়ে উঠেছ তা তো জানতাম না। ডাক্তারি করার আগে তোমার সঙ্গে পরামর্শ না করে তো ভুল করেছি!
শুধু ডাক্তারি তো নয়, তা বলি নি আমি। ডাক্তারিতে পসার হবে না, এ কথা তোমার হাতে লেখা নেই। থাকলেও সে লেখা পড়বার ক্ষমতা আমার নেই। তোমার হাতে লক্ষণ আছে উন্নতি করবার অক্ষমতার। নিজে উপাৰ্জন করে বড়লোক হওয়ার ক্ষমতা তোমার নেই, তাই বলে তোমার যে টাকা হবে না তাও বলা চলে না। অন্য কেউ তোমার টাকা খাঁটিয়ে তোমাকে আরো বড়লোক করে দিতে পারে, কোনো আত্মীয় মারা গিয়ে সম্পত্তি দিয়ে যেতে পারে, লটারির টিকিট কিনে টাকা পেতে পার। তোমার হাত দেখে যদি বলি টাকা তোমার হবে না, শান্তি স্বস্ত্যয়ন কর, সেটা হবে বুজরুকি। কিন্তু যদি বলি নিজের চেষ্টা আর পরিশ্রমে টাকা তোমার হবে না, সেটা হবে বিজ্ঞান। হাত দেখারও খানিকটা বিজ্ঞান, বাকিটা বুজরুকি। আর এই বুজরুকির জন্যই খুঁটি জিনিসটুকুর ওপর লোকের বিশ্বাস নষ্ট হয়ে গেছে। বেশি ফকির সুযোগ থাকলে বিজ্ঞান ভেস্তে যায়। ফুটপাতের তিলক আঁটা উড়ে গণৎকারের মতো ডাক্তার গজাতে পায় না বলে তোমাদের লোকে বিশ্বাস করে, নিমুনিয়া হলে তোমরা অনেকে ম্যালেরিয়ার চিকিৎসা কর, তবু।