কতকটা পাঞ্জাবি এবং কতকটা শার্টের মতো দেখিতে তার নিজস্ব ডিজাইনের জামাটি গায়ে দিয়া রাজকুমার ঘরের বাহিরে আসিল।
বাড়ির দোতলার অর্ধেকটা দখল করিয়া আছে স্বামী-পুত্র এবং স্বামীর দুটি ভাইৰােনসহ মনোরমা নামে রাজকুমারের এক দূর সম্পর্কের দিদি। প্রথমে তারা ভাড়াটে হিসাবেই আসিয়াছিল। এবং প্রথম মাসের বাড়ি ভাড়াও দিয়াছিল ভাড়াটে হিসাবেই। কিন্তু সেই এক মাসের মধ্যে প্রায়-সম্পর্কহীন ভাইবোনের সম্পর্কটা একটু ঘনিষ্ঠ হইয়া দাঁড়ানোয় মনোরমা একদিন বলিয়াছিল, দ্যাখ ভাই রাজু, তোমার হাতে ভাড়ার টাকা তুলে দিতে কেমন যেন লজ্জা করে।
শুনিয়া রাজকুমার ভাবিয়াছিল, সেরেছে। এই জন্য সম্পর্ক আছে এমন মানুষকে ভাড়াটে দিতে অজিত বারণ করেছিল।
মনোরমা আবার বলিয়াছিল, ভাড়া নেওয়ার সম্পর্ক তো তোমার সঙ্গে আমাদের নয়। রাজকুমার কথা বলে নাই। বলিতে পারে নাই।
–তার চেয়ে এক কাজ করা যাক না? একলা মানুষ তুমি, ঠাকুর চাকর রেখে হাঙ্গামা পোয়াবার তোমার দরকার? আমি থাকতে ঠাকুরের রান্নাই বা তোমাকে খেতে হবে কেন?
গজেন মন্দ রাঁধে না।
আহা, কি রান্নাই ব্ৰাধে! কদিন খেয়েছি তো এটা ওটা চেয়ে নিয়ে। জিভের স্বাদ তোমার নষ্ট হয়ে গেছে রাজু ভাই, দুদিন আমার রান্না খেলে ওর ডাল তরকারি মুখে দিতে পারবে না।
প্রস্তাবটা প্রথমে রাজকুমারের ভালো লাগে নাই। একে নিজের জন্য ঠাকুর চাকর রাখিয়া। সংসার চালানোর যত হাঙ্গামাই থাক, যে ভাবে খুশি সংসার চালানো এবং যা খুশি করা, যখন খুশি আর যা খুশি খাওয়ার সুখটা আছে। কিন্তু এখন মনোরমা আর অজানা অচেনা প্রায়-সম্পর্কহীন। আত্মীয়া নয়, এক মাসে সে প্রায় আসল দিদিতে পরিণত হইয়া গিয়াছে। তার এ ধরনের প্রস্তাবে না-ই বা বলা যায় কেমন করিয়া?
সেই হইতে মনোরমা ভাড়ার বদলে রাজকুমারকে চার বেলা খাইতে দেয়, তার ঘরখানা। গুছানো ছাড়া দরকারি অন্য সব কাজও করিয়া দেয়। রাজকুমার তার ঘর গুছাইতে দিলে যে মনোরমা নিজেই হোক বা তার ননদকে দিয়াই হোক এ কাজটা করিয়া দিত, তাতেও কোনো সন্দেহ নাই।
রাজকুমার বাহিরে যাইতেছে টের পাইয়া মনোরমা ডাকিল, কে যায়? রাজু? একবারটি শুনে যাবে রাজু ভাই, শুধু একটিবার?
দিনের মধ্যে রাজকুমারকে সে অন্তত আট-দশবার ডাকে কিন্তু প্রত্যেকবার তার ডাক শুনিয়া মনে হয়, এই তার প্রথম এবং শেষ আহ্বান, আর কখনো ডাক দিয়া সে রাজকুমারকে বিরক্ত করিবে না। দক্ষিণের বড় লম্বাটে ঘরখানার মেঝেতে বসিয়া মনোরমা সেলাই করিতেছিল। এ ঘরে আসবাব খুব কম। খাট, ড্রেসিং টেবিল আর ছোট একটি আলমারি ছাড়া আর যা আছে সে সবের জন্য বেশি জায়গা দিতে হয় নাই। পরিষ্কার লাল মেঝেতে গরমের সময় আরামে গড়াগড়ি দেওয়া চলে।
এত শিগগিরি যাচ্ছ কেন রাজু ভাই?
সেখানে যাচ্ছি না।
কোথায় যাচ্ছ তবে?
একটা ফোন করে আসব।
ও, ফোন করবে। পাঁচটার সময় ওখানে যেও, তা হলেই হবে। কালী সেজেগুজে ঠিকঠাক হয়ে থাকবে, বলে দিয়েছি।
আজ যেতে পারব না দিদি।
মনোরমা হাসিমুখে বলিল, পারবে না? একটা কাজের ভার নিয়ে শেষকালে ফ্যাসাদ বাধানোর স্বভাব কি তোমার যাবে না, রাজুভাই? কালীকে আজ আনাব বলে রেখেছি, কত আশা করে আছে মেয়েটা, কে এখন ওকে আনতে যাবে?
আমার মাথা ধরেছে–ধরেছে।
আবার মাথা ধরেছে? কতবার বললাম একটা মাদুলি নাও–না না, ওসব কথা আর আরম্ভ কোরো না রাজু ভাই, ওসব আমি জানি, আমি মুখ গেঁয়ো মেয়ে নই। মাদুলি নিলে মাথাধরা সেরে না যাক, উপকার হবে।
ছাই হবে।
কিছু উপকার হবেই। ভূতেও তো তোমার বিশ্বাস নেই, কিন্তু রাতদুপুরে একা একা শ্মশান ঘাটে গিয়ে দেখ তো একবার ভয় না করলেও দেখবে কেমন কেমন লাগবে। অবিশ্বাস করেও তুমি একটা মাদুলি নাও, আমার কথা শুনে নাও, মাথার যন্ত্রণা অন্তত একটু কম হবেই।
মনোরমা হঠাৎ গম্ভীর হইয়া গেল।
মাথা ধরুক আর যাই হোক, কালীকে তোমার আনতে যেতে হবেই রাজু ভাই। না গেলে কোনোদিন তোমার সঙ্গে কথা বলব না।
বেশ বোঝা যায়, মনোরমা রাগ করে নাই, শুধু অভিমানে মুখ ভার করিয়াছে। স্নেহের অভিমান, দাবির অভিমান।
রাজকুমার মৃদু হাসিয়া বলিল, আচ্ছা দেখি। যেতে পারলে যাবখন।
গিরীন্দ্রনন্দিনীর মা ঘরে ঘুমাইতেছিল। গিরি নিজেই দরজা খুলিয়া দিল। রোগা লম্বা পনের-ষোল বছরের মেয়ে, তের বছরের বেশি বয়স মনে হয় না। রাজকুমারের পরামর্শে রসিকবাবু মেয়েকে সম্প্রতি একটি পুষ্টিকর টনিক খাওয়াইতে আরম্ভ করিয়াছেন। টনিকের নামটা রাজকুমার অজিতের কাছে সংগ্রহ করিয়াছিল।
অজিত বলিয়াছিল, এমন টনিক আর হয় না রাজু। ভুল করে একবার একটা সাত বছরের মেয়েকে খেতে দিয়েছিলাম, তিন মাস পরে মেয়েটার বাবা পাগলের মতো তার বিয়ের জন্য পাত্র খুঁজতে আরম্ভ করল।
গিরি মাসখানেক টনিকটা খাইতেছে কিন্তু এখনো কোনো ফল হয় নাই। তবু সেমিজ ছাড়া শুধু ড়ুরে শাড়িটি পরিয়া থাকার জন্য গিরি যেন সঙ্কোচে একেবারে কাবু হইয়া গেল। যতই হোক, বাঙালি গৃহস্থ ঘরের মেয়ে তো, পনের-ষোল বছর বয়স তো তার হইয়াছে। ড়ুরে শাড়ি দিয়া ক্রমাগত আরো ভালোভাবে নিজেকে ঢাকিবার অনাবশ্যক ও খাপছাড়া চেষ্টার জন্য গিরির মতো অল্প অল্প বোকাটে ধরনের সহজ সরল হাসিখুশি ছেলেমানুষ মেয়েটাকে পর্যন্ত মনে হইতে লাগিল বয়স্কা পাকা মেয়েমানুষ।
ছোট উঠান, অতিরিক্ত ঘষা থাকায় ঝকঝকে, তবু যেন অপরিচ্ছন্ন। কলের নিচে ছড়ানো এঁটো বাসন, একগাদা ছাই, বাসন মাজা ন্যাতা, ক্ষয় পাওয়া ঝাঁটা, নালার ঝাঁঝরার কাছে পানের পিকের দাগ, সিঁড়ির নিচে কয়লা আর ঘুটের ভূপ, শুধু এই কয়েকটি সঙ্কেতেই যেন সযত্নে সাফ করা উঠানটি নোংরা হইয়া যাইতেছে।