মনোরমাও রাজকুমারের ভাবান্তরে আশ্চর্য হইয়া গিয়াছে। এমন বোকা সে নয় যে মনে করিবে কালীকে হঠাৎ বেশি পছন্দ হইয়া যাওয়ায় সর্বদা তাকে ডাকিয়া রাজকুমার তার সঙ্গে ভাব করিতে চায়। পছন্দ হইয়া থাকিলে আর ভাব করার ইচ্ছা জাগিয়া থাকিলে এভাবে যখন তখন বিনা কারণে ডাকার বদলে সে বরং বিশেষ দরকার হইলেও কালীকে ডাকিত না। রাজকুমারকে অন্য সকলে যতটা চেনে মনোরমা তার চেয়ে অনেক বেশিই চিনিয়াছে। গিরীন্দ্রনন্দিনীর সঙ্গে যেমন ব্যবহারই রাজকুমার করিয়া থাক, যদি ধরিয়াও নেওয়া যায় যে হঠাৎ কেঁকের মাথায় সে অন্যায় ব্যবহারই করিয়াছিল, গিরির টানেই সে যে সেদিন তাদের বাড়ি গিয়াছিল, মনোরমা তা বিশ্বাস করে না। গিরির জন্য যাইতে ইচ্ছা হইলে সে কখনো সে বাড়ির চৌকাঠ মাড়াইত না।
মনোরমা ভাবিয়া কূলকিনারা পাইতেছিল না, রাজকুমার তার সমস্ত ভাবনা ছিটাইয়া দিল। সকালবেলা রাজকুমার তাকে বলিল, কালীকে রিণিদের বাড়ি একটু নিয়ে যাচ্ছি দিদি।
ওমা, কেন?
শুধু ঘরে বসে থাকবে? দু-চারজনের সঙ্গে একটু ভাবসাব করে আসুক?
মনোরমার মুখ হাসিতে ভরিয়া গেল।
বেশ তো নিয়ে যাও, আমায় আবার জিজ্ঞেস করা কেন?
কালীর অঙ্গপ্রত্যঙ্গের বৈশিষ্ট্য মনের মধ্যে বহিয়া নিয়া গিয়া রিণি, সরসী, মালতী আর অন্য মেয়েদের সঙ্গে মিলাইয়া দেখিতে রাজকুমারের বড় অসুবিধা হইতেছিল। ওরকম আন্দাজী গবেষণায় এত বড় একটা তথ্য কি যাচাই করা চলে? পাশাপাশি দাঁড় করাইয়া কালীর সঙ্গে অন্য মেয়ের দেহের গড়নের তুলনা না করিলে অনুমানকে প্রমাণ বলিয়া গ্রহণ করা উচিত হইবে না।
কালীকে সঙ্গে করিয়া সে দুবেলা বাহির হয়, এক এক জনের বাড়ি গিয়া কালীর সঙ্গে পরিচয় করাইয়া দেয়। সকলে তারা ভাবে এ আবার কি খেয়াল রাজকুমারের? মনোরমা খুব খুশি হয়। এতদিন তার শুধু আশা ছিল, এবার তার ভরসা জাগে যে আশা হয়তো তার মিটিবে।
ধীরে ধীরে রাজকুমারের কাছে তার অস্পষ্ট অনির্দিষ্ট অনুমান স্পষ্ট প্রমাণিত সত্য হইয়া উঠিতে থাকে। দ্বিধা সন্দেহ মিলাইয়া যায়। মাঝে মাঝে তার মনে হইতেছিল, মাথাটা বুঝি তার খারাপ হইয়া গিয়াছে, পাগলের মতো সে অনুসরণ করিতেছে নিজের বিকৃত চিন্তার। এই আত্মগ্লানির বদলে এখন সে অনুভব করিতে থাকে আবিষ্কারের গর্ব।
কালীকে দেখিয়া তার মনে হইয়াছিল, তার দেহের গড়ন ঘরোয়া, অন্তঃপুরের একটি বিশেষ আবেষ্টনীতে একটি বিশেষ জীবনের সে উপযোগী! এখন সে জানিতে পারিয়াছে কেবল কালী একা নয়, সকলের দেহের গড়নেই এই সঙ্কেত আছে, দেহ দেখিয়া বুঝিতে পারা যায় সমাজের নানা স্তরে জীবনের বহু বিচিত্র পরিবেশের কোনটিতে সে খাপ খাইবে।
শুধু মন নয়, দেহের গঠন দেখিয়াও বিচার করিতে হয় কোন জীবন কার পক্ষে স্বাভাবিক, কোন জীবনে কার বিকাশ বাধা পাইবে না।
দেহ? এতকাল রিণি, সরসী আর মালতীর মনের সঙ্গেই তার পরিচয় ছিল, আজ তাদের দেহ কি বিস্ময়কর সংবাদই তাকে জানাইয়াছে! শুধু মনের হিসাব ধরিয়া সংসারে নিজেদের স্থান বাছিয়া নিতে গেলে জীবন ওদের ব্যর্থ হইয়া যাইবে। অসংখ্য নারী ও পুরুষের যেমন গিয়াছে।
একদিন সরসীকে রাজকুমার বলিল, রিণি আর মালতীকে নেমন্তন্ন কর না?
কেন?
এমনি, তোমাদের একটা গ্রুপ ফটো নেব।
কবে?
কাল সকালে।
হঠাৎ আমাদের ফটো নেবার শখ হল কেন?
শখের কি কেন থাকে সরসী?
এসব শখের থাকে। আচ্ছা বলব। কিন্তু সকালে কেন, বিকেলে বললে হবে না?
তাই বোললা। তিনটে-চারটের মধ্যে যেন আসে।
রাজকুমার একটু ভাবিল, খানিক ইতস্তত করিয়া বলিল, আচ্ছা, জ্যোৎস্না, মমতা ওদের বললে হয় না? আর তোমার সেই রুক্মিণীকে?
ওদেরও ফটো নেবে নাকি?
দোষ কি?
সরসী হাসিল, না দোষ কিছু নেই। হঠাৎ এতগুলি মেয়েকে একত্র করে ফটো নিতে চাইলে একটু খাপছাড়া মনে হবে, আর কিছু নয়। সে ব্যবস্থা আমি করে দেব। কিন্তু জ্যোৎস্না, মমতা আর রুক্মিণীকে নয় চিনলাম, ওদের কারা?
লিস্ট করে দিচ্ছি।
লিস্ট? প্রকাণ্ড গ্রুপ হবে বল? এত সব অদ্ভুত শখ চাপে কেন তোমার? দুদিন যদি কিছু তুমি না কর, তিন দিনের দিন একটা কিছু করে অবাক করে দেবেই দেবে। এমনি চালচলন ভাবভঙ্গি দেখে মনে হয় বয়স বুঝি সত্তর পেরিয়েছে, হঠাৎ যে তোমার কি হয় বুঝি না।
রাজকুমার সতেরটি মেয়ের নাম লিখিয়া লিস্ট করিয়া দিলে সরসী ভুরু কুঁচকাইয়া বলিল, এতগুলি মেয়েকে বলতে হবে? কি ধরনের গ্রুপ হবে এটা? বান্ধবী গ্রুপ, না শুধু চেনা মেয়ের গ্রুপ কুমারী গ্রুপ বলা চলবে না, তিন জনের বিয়ে হয়েছে।
কি যেন বুঝিবার চেষ্টা করিতে করিতে চিন্তিতভাবে সরসী ধীরে ধীরে মাথা নাড়ে, রাজকুমারের চোখে মানে আবিষ্কার করিতে চায়।
ফটোর কথা মিছে। কি যেন মতলব আছে তোমার। আমায় বল রাজু।
ওদের সকলকে একত্র করে দেখতে চাই।
কেন?
একটা ব্যাপার বুঝতে চাই। তুমি বুঝবে না, সরসী।
বুঝব না? তোমায় আমি সকলের চেয়ে ভালো বুঝি, তা জান?
রাজকুমার একটু হাসিল। হাসিটা সরসীর পছন্দ হইতেছে না টের পাইয়া সঙ্গে সঙ্গে আবার গম্ভীর হইয়া গেল।
জানতাম না, কিন্তু মেনে নিচ্ছি। তবে এটা ঠিক আমার বোঝার কথা নয়। এ অন্য ব্যাপার। রাজেনবাবুকে ভালো বুঝলেও তার নতুন মেটিরিয়াল স্পিরিচুয়ালিজমের থিয়োরি কি বুঝতে পারবে ভরসা কর?
থিয়োরি না বুঝতে পারি থিয়েরিটা কোন বিষয়ে সেটুকু বুঝতে পারব বৈকি।