এরকম মনে হয় কেন? সাজপোশাকের এমন কোন নূতনত্ব তো কালীর নাই যে জন্য এরকম একটা ধারণা জন্মিতে পারে। সাধারণ বাঙালি সংসারের আর দশটি মেয়ের মতোই তার সাধারণ বেশভূষা। অন্য কোনো মেয়েকে দেখিয়া তো আজ পর্যন্ত তার মনে হয় নাই, দেয়াল আর ঘোমটার আড়ালে শুধু একজনের দৃষ্টিকে বিহ্বল করার জন্য তার রূপযৌবন, দেহটি শুধু তার সেবা আর গৃহকর্মের উপযোগী:
রিণি, সরসী আর মালতীর সঙ্গে, আত্মীয় এবং বন্ধু পরিবারের মেয়েদের সঙ্গে, কালীকে মিলাইয়া দেখিয়া রাজকুমার রহস্যভেদের চেষ্টা করে। ট্রামে বাসে ঘোমটা-টানা ঘোমটা-খোলা বৌ আর স্কুল-কলেজের মেয়ে উঠিলে তাদের সঙ্গেও মনে মনে কালীকে মিলাইয়া দেখিতে তার ইচ্ছা হয়।
নিজের এক অলস কল্পনার ভিত্তি খুঁজিয়া বাহির করিতে গিয়া এমন এক বিস্ময়কর সত্য প্রথম আবিষ্কারের অস্পষ্টতায় আবৃত হইয়া তার মনে উঁকি দিতে থাকে যে রাজকুমার অভিভূত হইয়া পড়ে। ব্যাপারটা আরো ভালো করিয়া বুঝিবার জন্য তার উৎসাহ বাড়িয়া যায়। তার এই খাপছাড়া গবেষণার যে একটি অতি বিপজ্জনক দিক আছে এটা তার খেয়ালও থাকে না।
যে রাজকুমারের এতকাল দেখা পাওয়াই কঠিন ছিল হঠাৎ তার ঘন ঘন আবির্ভাব ঘটিতে থাকায় এবং তার শান্ত নির্বিকার দৃষ্টি তীক্ষ্ণ ও অনুসন্ধিৎসু হইয়া উঠায় আত্মীয় জন বন্ধুবান্ধবের বাড়ির মেয়েদের চমক লাগিয়া যায়। রাজকুমারের ব্যগ্ৰ উৎসুক চাহনি সর্বাঙ্গে সঞ্চারিত হইতেছে দেখিয়া কেউ দারুণ অস্বস্তি বোধ করে, কেউ মনে রাখিয়া যায়, কেউ অনুভব করে রোমাঞ্চ। প্রত্যেকে তারা বিস্ময়ের সঙ্গে ভাবিতে থাকে, এতকাল পরে আমার মধ্যে হঠাৎ কি দেখল যে এমন করে তাকিয়ে থাকে? কেউ তার সামনে আসাই বন্ধ করিয়া দেয়, কেউ কথা ও ব্যবহারে কঠিনতা আনিয়া দূরত্ব সৃষ্টির চেষ্টা করে, কেউ আরো কাছে সরিয়া আসিতে চায়।
রিণি, সরসী আর মালতী রাজকুমারের এই অদ্ভুত আচরণ তিন ভাবে গ্রহণ করিয়াছে। আশ্চর্য হইয়া গিয়াছে তিনজনেই, অস্বস্তিও বোধ করিয়াছে প্রায় একই রকম, কিন্তু ব্যাপার বুঝিবার চেষ্টায় তাদের মনে এমন ভিন্ন ভিন্ন চিন্তার উদয় হইয়াছে যে জানিতে পারিলে মানুষের মন সম্বন্ধেও একটা নূতন জ্ঞান খুব সহজেই রাজকুমারের জন্মিয়া যাইত।
রিণি ভাবে : এতদিনে কি বুঝিতে পারা গেল সেদিন গান প্র্যাকটিস করার সময় সে অমন আগ্রহের সঙ্গে মুখ বাড়াইয়া দিলে রাজকুমার তাকে কেন অপমান করিয়াছিল? রাজকুমারের মন কবিত্বময়, বাস্তব জগতের অনেক উঁচুতে নিজের মানস-কল্পনার জগতে সে বাস করে; বড় ভাবপ্রবণ প্রকৃতি রাজকুমারের। তার মনের ঐশ্বর্য রাজকুমারকে মুগ্ধ করিয়াছে, তার সি কথা গান ভাবালোকের অপার্থিব আনন্দ দিয়াছে রাজকুমারকে, তার সান্নিধ্য অনুভব করিয়াই রাজকুমারের মন এমনভাবে অভিভূত হইয়া গিয়াছে যে একটি চুম্বনের প্রয়োজনও সে বোধ করে নাই। সেদিন রাজকুমার তাই চমকাইয়া গিয়াছিল, কি করিবে ভাবিয়া পায় নাই। গান শুনিতে শুনিতে যে মানুষটা স্বপ্ন দেখিতেছিল হঠাৎ সচেতন হওয়ার পর তার খাপছাড়া ব্যবহারে অপমান বোধ করিয়া সেদিন তার রাগ করা উচিত হয় নাই। হয়তো সেদিন রাজকুমারের প্রথম খেয়াল হইয়াছিল, সে শুধু মন আর হাসি গান কথা নয়, একটা শরীরও তার আছে। হঠাৎ যে রাজকুমার এমন অসভ্যের মতো খুঁটিয়া খুঁটিয়া তার সর্বাঙ্গে চোখ বুলাইতে আরম্ভ করিয়াছে, এটা হয়তো তার এই নূতন চেতনার প্রতিক্রিয়া। তার অপূর্ব রূপ প্রথম দেখিতে আরম্ভ করিয়া রাজকুমারের চোখে ধাঁধা লাগিয়া গিয়াছে।
সরসী ভাবে : এতদিন তার শরীরটাই ছিল রাজকুমারের কাছে বড়। তার দিকে তাকাইলে মানুষ সহজে চোখ ফিরাইতে পারে না, তার এই দেহের বিস্ময়কর রূপ মানুষের মধ্যে দুরন্ত কামনা জাগাইয়া দেয়। এতকাল রাজকুমার তার শরীরটা দেখিয়াই মুগ্ধ হইয়াছে, তাই লজ্জা সঙ্কোচে তার দিকে ভালো করিয়া তাকাইতে পারে নাই। তারপর রাজকুমার বুঝি তার অন্তরের সৌন্দর্য সম্বন্ধে সচেতন হইয়া উঠিয়াছে। পুরুষের মন-ভুলানো মেয়েলি হাবভাবের সস্তা অভিনয় সে যে কখনো করে না, লজ্জাবতী লতা সাজিয়া থাকে না, নাকী সুরে কথা বলে না, ভাবপ্রবণতা পছন্দ করে না, বাজে খেয়ালে হালকা খেলায় সময় নষ্ট করে না, এসব বোধহয় রাজকুমারের খেয়াল হইয়াছে। খুব সম্ভব সেদিনের সভায় রাজকুমার তার প্রকৃত পরিচয় পাইয়াছিল। তারপর ক্ৰমে ক্ৰমে তার ভিতরের গভীরতার জন্য রাজকুমার তাকে ভালবাসিয়া ফেলিয়াছে। ভালবাসে বলিয়া এখন আর রাজকুমার তার দিকে চাহিতে সঙ্কোচ বোধ করে না, মুগ্ধ বিস্ময়ে অভিভূত হইয়া যায়।
মালতী ভাবে : ডি ছি, রাজকুমার কেমন মানুষ? সে তো স্বপ্নেও ভাবিতে পারে নাই। রাজকুমারের এমন পরিচয়ও তাকে পাইতে হইবে। সে ভালবাসে জানা গিয়াছে কিনা তাই রাজকুমার এখন তাকে যাচাই করিতেছে। তাকে নয়, তার দেহকে। কোথায় তার কোন খুঁত আছে। রূপের, খুঁজিয়া খুঁজিয়া তাই এখন বাহির করিতেছে রাজকুমার। ভালবাসার দৃষ্টিতে যদি এমন মনোযোগের সঙ্গে রাজকুমার তাকে দেখিত! কিন্তু চোখে তার ভালবাসা নাই। মনে মনে কি যেন সে হিসাব করিতেছে আর যাচাই করার দৃষ্টিতে তার সর্বাঙ্গে চোখ বুলাইতেছে!
কালীও অনেক কথা ভাবে। কিছু সে বুঝিতে পারে না, তার ভয় হয়, লজ্জায় সে আড়ষ্ট হইয়া যায়। আপনা হইতে কখনো যে ডাকিত না, হঠাৎ একবার সে কেন অকারণে কাছে ডাকে? সামনে দাড় করাইয়া কেন বলে, এদিক মুখ কর, ওদিকে মুখ কর, পিছন ফিরে দাঁড়াও?