মুখের ভাতটা গিলিতে রাজকুমারকে তিনবার চেষ্টা করিতে হইল।
ভালোই লাগে।
বড় লাজুক হয়েছে মেয়েটা। কিছুতে তোমার সামনে আসতে চায় না। তা বড়সড় হয়ে। উঠছে, একটু লজ্জা হবে বৈকি। চোদ্দ পেরিয়ে পনেরয় পা দিয়েছে।
কালীর বয়সটা রাজকুমার জানি, তার সাদাসিধে মাটি রাজকুমারের কাছে বলিয়া ফেলিয়াছিল। কালীর বয়সটা মনোরমা একেবারে দু বছর বাড়াইয়া দিতে চায় কেন প্রথমটা রাজকুমার বুঝিয়া উঠিতে পারিল না। তারপর একটা অবিশ্বাস্য কথা মনে আসায় অবাক হইয়া মনোরমার মুখের দিকে চাহিয়া রহিল।
তোমার নামে কালী কিন্তু আমার কাছে একটা নালিশ করেছে রাজু ভাই!
মনোরমার মুখে কৌতুকের হাসি। চোখ দিয়া তাঁর হাসি দেখিতে দেখিতে কান দিয়া তার কথা শুনিয়া রাজকুমারের যেন কিছুক্ষণের জন্য ধাঁধা লাগিয়া গেল। কালী তবে নালিশ করিয়াছে? কালীর নালিশ শুনিয়া মনোরমা তাকে অনুযোগ দিতেছে সকৌতুকে!
তুমি নাকি ওকে মিউজিয়াম দেখাতে নিয়ে যাবে বলেছিলে? বিকেলে আমায় বলছিল, তুমি নাকি ভারি খারাপ লোক, কথা দিয়ে কথা রাখ না। আমি বললাম, যা না, বলগে না তুই তোর রাজুদাকে? তা মেয়ে বলে কি, লজ্জা করে দিদি!
জলের গেলাস তুলিয়া রাজকুমার গেলাসের অর্ধেকটা খালি করিয়া ফেলিল।
খাওয়ার পর অন্ধকার ঘরে চেয়ারে বসিয়া রাজকুমার সিগারেট টানিতেছে, দরজার কাছে বিছানো বারান্দার বালবের আলোয় একটি ছায়া আসিয়া পড়িল। ছায়া আর নড়ে না। মনোরমার ছায়া নিশ্চয় নয়। ছায়া ফেলিয়া কারো ঘরের বাহিরে দরজার পাশে দাঁড়াইয়া থাকার ধৈর্য মনোরমার নাই।
রাজুদা?
রাজকুমার সাড়া দিতেই কালী ঘরে আসিল।
মসলা নি।
প্রতিফলিত আবছা আশোয় হাত বাড়ানো দেখা যায়। রাজকুমারের হাতের তালুতে মনোরমার সযত্নে প্রস্তুত মসলা দিয়া কালী বলিল, আঁধার দেখে এমন ভয় করছিল! জানি আপনি আছেন, তবু ভাবছিলাম, যদি না থাকেন? আঁধারে আমি বড্ড ডরাই।
আলোটা জ্বাল।
জ্বালব?
কালী বোকা নয়, কিছু শুধু জানে না। ইঙ্গিতে ও সঙ্কেতের ভাষা এখনো শেখে নাই। মালতী সরসী বা রিণি যদি ছুটিয়া ঘর ছাড়াইয়া চলিয়া যাওয়ার এক ঘণ্টার মধ্যে ফিরিয়া আসিয়া এভাবে ইতস্তত করিয়া জিজ্ঞাসা করিত জ্বালাব?–একটি শব্দে কি মহাকাব্যই সৃষ্টি হইয়া যাইত! কালী শুধু প্রশ্নের ভঙ্গিতে তার কথারই পুনরাবৃত্তি করিয়াছে।
আলো জ্বালিয়া কালী চলিয়া গেল। রাজকুমার ভাবে, অভিধান নিরর্থক। শব্দের মানে তারাই ঠিক করে, যে বলে আর যে শোনে। কাজ ও উদ্দেশ্যের বেলাতেও তাই। কি ব্যাপক মানুষের ব্যক্তিগত স্বাধীনতা!
০৪. বর্ষা শেষ হইয়াছে
মাঝে মাঝে বাতাসে হঠাৎ যে শীতের আমেজ পাওয়া যায় এখনো তা ভিজা ভিজা মনে হয়, কান্নার শেষে তোয়ালে দিয়া মুছিয়া নেওয়ার পর মালতীর গায়ের শীতল স্পর্শের মতো। কালী মার কাছে চলিয়া গিয়াছিল, কয়েকদিনের জন্য আবার আসিয়াছে। মনোরমার তাড়া নাই, বিফল হওয়ার ভয়ও যেন নাই। কালীর দেহে যৌবনের বিকাশে যেমন এতটুকু ব্যস্ততা দেখা যায় না অথচ বিকাশ তার অনিবার্য গতিতে ঘটিতেই থাকে, মনোরমার অভিযানও তেমনি ধীর স্থির মন্থর গতিতে গড়িয়া ওঠে। খেলার ছলে হৃদূস্পন্দন পরীক্ষা করার বিরুদ্ধে কালীর প্রতিবাদ যেমন রাজকুমারের অজ্ঞাতসারেই তিলে তিলে হুকুম হইয়া মাথা তুলিতে আরম্ভ করে, তাকে ঘিরিয়া মনোরমার জাল বোনাও তেমনি হইয়া থাকে তার অদৃশ্য।
কালীকে মনোরমা কখনো বেশি সাজায় না, তার ঘরোয়া সাধারণ সাজেই বৈচিত্র্য সৃষ্টির চেষ্টা করে। কালীর একরাশি কালো চুল আছে, কোনোদিন মনোরমা লম্বা বিনুনি ঝুলাইয়া দেয়, কোনোদিন রচনা করে ফুলানো কঁপানো খোপা। সকালে ঘরের কাজ করার সময় কালীর গায়ে সাদাসিধে ভাবে জড়ানো থাকে নিমন্ত্রণে যাওয়ার জমকালো দামি শাড়ি, বিকালে সযত্ন প্রসাধনের পর তাকে পরিতে হয় সাধারণ মিলের কাপড়।
সকালে কালী কাতর হইয়া বলে, ভালো কাপড়খানা নষ্ট হয়ে যাবে যে দিদি?
মনোরমা বলে, হোক। আঁচলটা জড়া দিকি কোমরে, ঘর দোর ঝাঁট দে রাজুর। খাটের তলায় ঝটাস ভালো করে।
বিকালে আরো বেশি কাতর হইয়া কালী বলে, এটা নয় দিদি, পায়ে পড়ি তোমার, ওটা পরি এখন, আবার খুলে রাখব একটু পরে?
মনোরমা বলে, না, অত ফ্যাশন করে কাজ নেই তোমার। গরিবের মেয়ে গরিবের মতো থাক।
কাছে টানিয়া আদর করিয়া বলে, বোকা মেয়ে, ভেঁড়া কাপড়ে তোকে যে বেশি সুন্দর দেখায় রে!
রাজকুমারের কাছে সে আফসোস করে, বড় চপল মেয়েটা রাজু, বড় চঞ্চল।
দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া বলে, তাও বলি, মেয়ে যেন মানুষের মন কাড়তে জন্মেছে। কি দিয়ে এমন মায়া জাগায় ছুঁড়ি ভগবান জানেন। ডাইনী এসে জন্মায় নি তো মানুষের পেটে? কদিনের জন্যে তো এসেছে, সেখানে পাড়াসুদ্ধ সবাই অস্থির, রোজ সবাই জিজ্ঞেস করে, কালী কবে ফিরবে গগা কালীর মা? যদুবাবু মস্ত বড়লোক ওখানকার, বংশ একটু নিচু, তার গিন্নি মাসিকে এখন থেকে সাধাসাধি করছে, ছেলে বিলেত থেকে ফিরলে কালীকে আমায় দিও কালীর মা।
তবে তো কালীর বিয়ের জন্য কোনো ভাবনাই নেই।
কে ভাবে ওর বিয়ের জন্য?
মনোরমার কাছে এসব শোনে আর কালীকে রাজকুমার একটু মনোযোগের সঙ্গে লক্ষ করে। তার মনে হয়, কেবল কথাবার্তা চালচলন শিক্ষা-দীক্ষার দিক হইতে নয়, কালীর গড়নটি পর্যন্ত যেন ঘরোয়া ছাঁচের, বহুকাল আগে মিসেস বের্নসের আঁকা গত শতাব্দীর বাঙালি নারীর ছবির আদর্শে কালীর দেহ গড়িয়া উঠিতেছে।