অন্তত আপনার নেই।
শুনিয়া আহত বিস্ময়ে রাজকুমারের মুখে কথা ফুটিল না।
শ্যামল একটু ইতস্তত করিয়া আবার বলিল, আপনাকে আমি শ্ৰদ্ধা করতাম, সে শ্রদ্ধা বজায় থাকলে মালতীর সম্বন্ধে আমার এতটুকু ভাবনা হত না। কিন্তু আপনি নিজেই আমার শ্ৰদ্ধা ভেঙে দিয়েছেন।
সেদিন সভায় তোমায় অপদস্থ করেছিলাম বলে?
না। গিরির সঙ্গে কুৎসিত ব্যবহার করেছিলেন বলে।
তারপর শ্যামল চলিয়া যাওয়ার আগে আরো যে দু-চারটি কথা বলিল, রাজকুমারের কানে গেল না। যেমন বসিয়াছিল তেমনিভাবে সে চুপ করিয়া বসিয়া রহিল। সেদিন অকথ্য গালাগালি দিয়াই তবে গিরীন্দ্রনন্দিনীর জননী তাকে রেহাই দেয় নাই, প্ৰায়শ্চিত্তের জেরটা যাতে আরো টানিয়া চলিতে হয় তার ব্যবস্থাও করিয়াছে।
গিরীন্দ্রনন্দিনীর সঙ্গে তার কুৎসিত ব্যবহারের সংবাদ আরো কত লোক জানিয়াছে কে জানে!
জীবনে এই প্রথম মিথ্যা দুর্নামের সংস্পর্শে আসিয়া রাজকুমারের মন যেন দিশেহারা হইয়া গেল। কতবার ভাবিল যে, লোকে যা খুশি ভাবুক, তার কি আসিয়া যায়, সে তো কোনো অন্যায় করে নাই! সে কেন জ্বালাবোধ করিবে তার সম্বন্ধে কে কোথায় কি মিথ্যা ধারণা পোষণ করিতেছে। ভাবিয়া? কিন্তু জ্বালা সে বোধ করিতেই লাগিল। অন্যায় না করুক, সেদিন ভুল সে করিয়াছিল, বোকামি করিয়াছিল। ভুলের শাস্তিও মানুষকে পাইতে হয় বৈকি। গরম চায়ে পর্যন্ত মুখ পুড়িয়া যায়।
এ দুর্নামের প্রতিবাদে তার কিছু বলিবার উপায় পর্যন্ত নাই। শ্যামলকে সমস্ত ব্যাপারটি খুলিয়া বলিলেও সে বুঝি না, বিশ্বাসও করিত না। শ্যামলের মতো অন্য সকলেও বুঝিবে না, বিশ্বাস করিবে না। নীরবে এ অপবাদ তাকে মানিয়া নিতে হইবে।
এমনি যখন মানসিক অবস্থা রাজকুমারের, অবরুদ্ধ নিরুপায় ক্রোধের উত্তেজনায় ভিতরটা যখন তার ফেনার মতো ফাটিয়া যাইতে চাহিতেছে আর সমস্ত জগতের উপর ভয়ঙ্কর একটা প্রতিশোধ নেওয়ার অন্ধ কামনা জাগিয়াছে, তখনকার মতো জগৎকে পাওয়া না গেলেও হাতের কাছে যাকে পাওয়া যায় তাকেই আঘাত করার জন্য ছটফট করিতেছে, ঘরে তখন আসিল কালী।
বলিল, দিদি ডাকছে, খেতে চলুন।
গিরির সমবয়সী কালী। গিরির মতো সেও সঙ্কীর্ণ আবেষ্টনীর মধ্যে বর্বরতার আবহাওয়ায় মেছুনি মায়ের কোলে মানুষ হইয়াছে। গিরিকে নিয়া একটা বদনাম যখন তার রটিয়াছে, কালীকে নিয়া আরেকটা বদনামও রটুক। রটুক, কি আসিয়া যায়? মনটা শান্ত হওয়ার সময় পাইলে নিজের খাপছাড়া খেয়ালে নিজেরই তার হাসি পাইত। এখন মনে হইল, খেয়ালটা না মিটাইতে পারিলে কোনোমতেই তার চলিবে না।
কালী, শোন।
কালী নিৰ্ভয়ে কাছে আগাইয়া আসিল, কি?
তোমার নাড়ি আছে কালী? অসুখ হলে ডাক্তাররা হাত ধরে যে পাস দ্যাখে, সেই নাড়ি।
আছে না? ও পাল্স সবারই থাকে।
কালীর মুখে কৌতুকের মৃদু হাসি ফুটিয়া উঠিল।
তোমার পাল্স নেই। এক একটি মেয়ের থাকে না।
পাল্স না থাকলে কেউ বাঁচে? মরে গেলে তখন পাস থাকে না। এই দেখুন কালী ডান হাতটি বাড়াইয়া দিল।
কব্জি ধরিয়া নাড়ি পরীক্ষার সুবিধা দেওয়ার জন্য ঘেঁষিয়া আসিল আরো কাছে।
তখন খেয়াল করে নাই, কিন্তু মনের মধ্যে ঘটনাটির পুনরাবৃত্তির সময় রাজকুমারের মনে পড়িয়াছে, হাত ধরামাত্র গিরীন্দ্রনন্দিনী কেমন যেন শক্ত হইয়া গিয়াছিল। কালীর কৌতুকের হাসি আর নির্ভয় নিশ্চিন্ত ভাব রাজকুমারের মনে অসন্তোষ জাগাইয়া তুলিল। এরকম হওয়ার তো কথা নয়!
ইস্! তোমার পা তো ভারি দুর্বল কালী?
কালীর হাসি মিলাইয়া গেল।
সত্যি?
তোমার হার্ট নিশ্চয় ভারি দুর্বল।
আমি তো জানি না।
দেখি তোমার হার্ট–?
গিরির হৃদ্স্পন্দন শুধু সে পরীক্ষা করিতে গিয়াছিল, কালীর হৃদ্স্পন্দন সে পরীক্ষা করিতে গেল এক হাতে তাকে বেষ্টন করিয়া ধরিয়া। হতভম্ব ভাবটা কাটিয়া যাইতে যতক্ষণ সময় লাগে ততক্ষণ কালী নিস্পন্দ হইয়া রহিল, তারপর রাজকুমারের হাত সরাইয়া দিয়া নিজেও একটু তফাতে সরিয়া গেল। সেখানে দাঁড়াইয়া শঙ্কিত প্রশ্ন আর মৃদু ভয় ও ভর্ৎসনা দুচোখে ফুটাইয়া রাজকুমারের দিকে চাহিয়া রহিল। এক মুহূর্ত পরে ছুটিয়া ঘর ছাড়িয়া চলিয়া গেল।
রাজকুমার ভাবিল, এবার মনোরমা আসিবে। আসিয়া অকথ্য গালাগালি শুরু করিয়া দিবে।
মনোরমা আসিল। অনুযোগও দিল।
খাবে না রাজু ভাই?
হ্যাঁ, যাই।
কালী নিশ্চয় মনোরমাকে কিছু বলে নাই। কালী ঘর হইতে ছুটিয়া বাহির হইয়া যাওয়ার। যতটুকু সময়ের মধ্যে মনোরমা তাকে খাইতে ডাকিতে আসিয়াছে তার মধ্যে এত বড় একটা গুরুতর কথা কালীর বলা ও মনোরমার শোনা সম্ভব নয়। গিরির মতো একনিশ্বাসে সমস্ত বিবরণই। তো কালী জানাতে পারিবে না। ব্যাপারটার একটু আভাস দিয়াই তার মুখে আর কথা ফুটিবে না। মনোরমাকে তখন খুঁটিয়া খুঁটিয়া জেরা করিয়া সব জানিতে হইবে। তাতে কিছু সময় লাগিবার কথা। মনোরমার গালাগালিটা তবে ভবিষ্যতের জন্য তোলা রহিল?
খাইতে বসিয়া রাজকুমার ঘাড় হেঁট করিয়া খাইয়া যায়। কাল মনোরমার হুকুমে কালী পরিবেশন করিয়াছিল। মনোরমা কি আজো তাকে ডাকিবে? ডাকিলে কালী যদি না আসে? ব্যাপার। বুঝিতে গিয়া মনোরমা যদি সমস্ত ব্যাপারটাই বুঝিয়া আসে? কি বিপদেই মনোরমা পড়িবে তখন। একটা মানুষকে খাওয়াইতে বসাইয়াছে, তার খাওয়াও নষ্ট করিতে পরিবে না; মনের রাগ চাপিয়াও রাখিতে পারিবে না।
কালীকে তোমার কেমন লাগে রাজু ভাই?