ঘরে একটিমাত্র চেয়ার, একটির বেশিকে স্থান দেওয়াও মুশকিল। শ্যামল সেই চেয়ারে বসে, রাজকুমার পা ঝুলাইয়া বসে তার খাটের বিছানায়।
এখন তার মনে হইতে থাকে, রাস্তায় সংক্ষেপে কথা সারিয়া শ্যামলকে বিদায় দিলেই ভালো। হইত। শ্যামলকে ওভাবে দাঁড়াইয়া থাকিতে দেখিয়া হঠাৎ অতখানি মমতা ও সহানুভূতি বোধ করিয়াছিল কেন কে জানে! মনে হইয়াছিল, ধীর স্থির শান্তভাবে গভীর আন্তরিকতার সঙ্গে ওর মানসিক বিপ্লব যতটুকু পারা যায় শান্ত করার চেষ্টা করা তার কর্তব্য। মর্মাহত ছোট ভাইটির মতো ছেলেটাকে কাছে টানিয়া সান্ত্বনা না দিলে অন্যায় হইবে। কারণ, তার বয়স বেশি, অভিজ্ঞতা বেশি, জ্ঞান বেশি, ধৈর্য ও সহিষ্ণুতা বেশি।
এমন খারাপ লাগিতেছে এখন! উপদেশ দিয়া এই বয়সের দুরন্ত হৃদয়াবেগসম্পন্ন ছেলেমানুষটিকে শান্ত করা! সে তো পাগলামির শামিল।
একবার চোখ তুলিয়া চাহিয়া শ্যামল অন্যদিকে তাকায়, হঠাৎ কিছু বলতে পারে না। এ তো জানা কথাই যে মনের মধ্যে তার ঝড় চলিতেছে, কথা আরম্ভ করা তার পক্ষে সহজ নয়। বাড়ির সামনে রাস্তায় প্রথম কেঁকে অনেক কথাই সে বলিয়া ফেলিতে পারি, এতক্ষণের ভূমিকার পর খেই হারাইয়া ফেলিয়াছে।
আপনি ওকে বিয়ে করবেন?
শ্যামলের কথা শুনিয়া রাজকুমার কিছুমাত্র আশ্চর্য হইল না। এই রকম প্রশ্নই সে প্রত্যাশা করিতেছিল।
এ কথা জিজ্ঞাসা করছ কেন?
আপনি তা বুঝতে পারছেন।
না, বুঝতে পারছি না। তুমি মালতীর অভিভাবক নও, আত্মীয়ও নও। আমাকে এ প্রশ্ন করার অধিকার তোমার নেই।
আমার অধিকার আছে।
শ্যামল এমন জোরের সঙ্গে কথাটা ঘোষণা করিল যে কথাটার সহজ মানে বুঝিতে রাজকুমারের একটু সময় লাগিল। মনে হইল সত্য সত্যই মালতী সম্পর্কে অন্য অধিকারও বুঝি শ্যামলের আছে।
কিসের অধিকার তোমার? তুমি নিজে মালতীকে বিয়ে করতে চাও, এই অধিকার?
শ্যামলের মেরুদণ্ড সিধা হইয়া গেল। সোজা রাজকুমারের চোখের দিকে চাহিয়া স্পষ্ট উচ্চারণে প্রত্যেকটি কথায় জোর দিয়া সে বলিল, বিয়ে করি বা না করি, ওকে আমি স্নেহ করি। আপনাদের ওসব কথার মারপ্যাচ আমি বুঝি না, সোজাসুজি এই বুঝি মালতীর এতটুকু ক্ষতি হলে আমার সহ্য হবে না। সেই দাবিতে আমি আপনাকে স্পষ্ট একটা কথা জিজ্ঞাসা করেছি, সোজা ভাষায় জবাব দিন।
তুমি বড় ছেলেমানুষ শ্যামল।
বাজে কথা বলে লাভ কি?
তারপর দুজনেই কিছুক্ষণের জন্য চুপ করিয়া গেল।
শ্যামল খালি গায়ে বসিয়া আছে, রাজকুমারের শুকনো কাপড়খানা শুধু সে পরিয়াছে, জামা গায়ে দেয় নাই। প্রয়োজনের বেশি সামান্য একটু ভদ্রতাও সে যেন রাজকুমারের কাছে গ্রহণ করিতে চায় না। সুন্দর ছিপছিপে গড়ন তার দেহের, বোধহয় অল্পদিন আগে ব্যায়াম আরম্ভ করিয়াছে, পেশীগুলি স্পষ্ট ও পুষ্ট হইয়া উঠিতেছে কিন্তু এখনো কঠিন হয় নাই। প্ৰথম হইতেই রাজকুমার কেমন মৃদু একটু ঈর্ষা বোধ করিতেছিল। এতক্ষণ বিশ্বাস করিতে পারে নাই। সুগঠিত মাংসপেশীর জন্য একজন তরুণকে সে হিংসা করিবে? এর চেয়ে হাস্যকর কথা আর কি হইতে পারে। কিন্তু ছেলেটার তেজ দেখিয়া রাগে ভিতরটা জ্বালা করিতেছে জানিয়া, গলাধাক্কা দিয়া ছেলেটাকে বাড়ির বাহির করিয়া দিবার ইচ্ছা জোর করিয়া চাপিয়া রাখিতে হইতেছে বলিয়া, ঈৰ্ষার অস্তিত্বটা আর নিজের কাছে অস্বীকার করা গেল না।
একটু আগে যার উপর গভীর মমতা জাগিয়াছিল, এখন তাকে আঘাত করিতে ইচ্ছা হইতেছে, মালতীর প্রতি তার প্রথম যৌবনের ভাবপ্রবণ অন্ধ ভালবাসার সুযোগ নিয়া হীন কাপুরুষের মতো অকারণ নিষ্ঠুর আঘাত করিবার সাধ জাগিতেছে।
শ্যামল বলিল, বলুন? জবাব দিন?
তুমি যাও শ্যামল।
আমার কথাটার জবাব দিন আগে? আপনার উদ্দেশ্যটা জানিয়ে দিন, আমি এক সেকেণ্ডও আপনাকে জ্বালাতন করব না।
মুখখানা শ্যামলের কালো হইয়া গিয়াছিল, রাজকুমারের সাড়াশব্দ না পাইয়া হাতের উল্টা পিঠ দিয়া সজোরে সে একবার কপালটা মুছিয়া ফেলিল। কপাল তার ঘামিয়া উঠিয়াছে।
বুঝতে আমি পারছি, উদ্দেশ্য ভালো হলে এত ইতস্তত করতেন না। তবু আপনার মুখ থেকে একবার শুনতে চাই।
শুনে কি করবে?
প্রশ্নটা যেন বুঝিতেই পারি না, এমনি ভাবে শ্যামল খানিকক্ষণ তার মুখের দিকে চাহিয়া রহিল। তারপর ধীরে ধীরে বলিল, কি করব? তা জানি না? আপনি তো জানেন আমার কিছু করবার ক্ষমতা নেই।
তুমি শুধু জানতে চাও?
একমুহূর্তে রাজকুমার যেন নিজেকে ফিরিয়া পাইল। কি ছেলেমানুষিই এতক্ষণ সে করিয়াছে এই ছেলেমানুষের সঙ্গে। জীবনের কেনাবেচার হাটে যাকে শুধু খেলনা দিয়া ভুলানো যায়, তার সঙ্গে এত সাবধানতার সঙ্গে শুরু করিয়াছে সুখ দুঃখ হাসি কান্নার পণ্য নিয়া বোঝাপড়ার তর্ক।
রাজকুমার একটা সিগারেট ধরাইল, কথা কহিল ধীরে ধীরে, অন্তরঙ্গভাবে, বন্ধুর মতো।
তোমাকে একটা কথা বলি শ্যামল। মালতীকে তুমি ভালবাস। তোমার এ ভালবাসা দুদিনের নয় নিশ্চয়? বিয়ে না হলেও চিরদিন তুমি মালতীকে ভালবেসে যাবে নিশ্চয়?
কিন্তু–
কিন্তু জানি। তুমি বলতে চাও, তোমার কথা আলাদা। মালতীর জীবনে এতটুকু দুঃখ আনার চেয়ে মরে যাওয়া তুমি ভালো মনে কর। কারণ, তুমি যে ভালবাস মালতীকে! টোকা দিয়া। সিগারেটের ছাই ঝাড়িয়া ফেলিয়া গলার সুর বদলাইয়া, কিন্তু আমি ওকে ভালবাসি না, তাই আমার সম্বন্ধে তোমার দুর্ভাবনার সীমা নেই। তোমার মতে, ভালবাসাটা তোমার একচেটিয়া সম্পত্তি, এ জগতে আর কেউ ভালবাসতে পারে না, আর কারো ভালবাসার অধিকার নেই।