মালতী বলিল, বৃষ্টি নেমেছে অনেকক্ষণ, এতক্ষণ ভিজে কাপড়ে কি করছিলে? বৃষ্টি যখন নামল, বাড়ি ফিরে গেলে না কেন? রাস্তায় ভিজে গেলে, তবু ফোন করতে এলে কি বলে?
জেরায় কাতর শ্যামল বলিল, দরকারি ফোন কিনা, ভাবলাম একটু ভিজলে আর কি হবে? একটা শুকনো কাপড় আর গেঞ্জি দেবে আমাকে? মালতী দ্বিধা করিল, যতক্ষণে দ্বিধার ভাব স্পষ্ট হইয়া ওঠে, ততক্ষণ। তারপর বলিল, শুকনো কাপড় দিয়ে কি করবে, রাস্তায় নামলেই তো কাপড় আবার ভিজে যাবে। একেবারে বাড়ি গিয়ে কাপড় ছাড়। বড় ছেলেমানুষ তুমি–সত্যি।
একখানা শুকনো কাপড় দিয়া বৃষ্টি ধরা পর্যন্ত অপেক্ষা করিতে না দিয়া ভিজা কাপড়ে তাকে এক রকম তাড়াইয়া দেওয়া হইল। শ্যামল হয় মালতীর কথার মানেই বুঝিতে পারি না অথবা বুঝিয়াও বিশ্বাস করিতে পারিল না, এমনি এক অদ্ভুত বিস্ময়ভরা দৃষ্টিতে সে খানিকক্ষণ মালতীর মুখের দিকে চাহিয়া রহিল। তারপর নীরবে বারান্দা পার হইয়া সিঁড়ি দিয়া নিচে নামিয়া গেল।
ঘরে গিয়া টেবিলের দুপাশের দুটি চেয়ারে বসিয়া দুজনেই চুপ করিয়া রহিল। মালতীর মুখখানি অস্বাভাবিক রকম গম্ভীর হইয়া গিয়াছে। কিছুক্ষণ পরে সেই অস্ফুটস্বরে বলিল, শ্যামল সব দেখেছে।
সব? সব মানে কি? রাজকুমার আশ্চর্য হইয়া গেল। জানালা দিয়ে দেখছিল?
হ্যাঁ তুমি যখন পড়াও, প্রায়ই এসে বারান্দায় কেউ না থাকলে জানালা দিয়ে উঁকি দেয়।
রাজকুমার আরো আশ্চর্য হইয়া গেল। প্রাণপণে একটু হাসিবার চেষ্টা করিয়া সে বলিল, তার মানে–?
মালতী সায় দিয়া বলিল, হ্যাঁ, তাই। এমন ছেলেমানুষ আর দেখি নি। একটু বয়স বাড়লেই এ ভাবটা কেটে যাবে জানি তবু এমন বিশ্রী লাগে মাঝে মাঝে! এ সব নীরব পূজার ন্যাকামি কোথেকে যে শেখে ছেলেরা!
ছেলেরা! যাদের সঙ্গে কলেজে পড়ে মালতী তারা কচি ছেলের দলে গিয়া পড়িয়াছে, এতই সে বুড়ি! রাজকুমারের এবার আপনা হইতেই হাসি আসিল।
একখানা শুকনো কাপড় চাইল, তাও দিলে না?
খুব অন্যায় হয়ে গেছে, না? একটু উদ্বেগের সঙ্গেই মালতী জিজ্ঞাসা করিল। তারপর মাথা নিচু করিয়া বলিল, দিতাম, অন্যদিন হলে দিতাম। আজ কাপড় দিলে বসে থেকে আমাদের জ্বালাতন করত।
আর পড়বে?
না। কি হবে পড়ে?
বলিয়া অনেকক্ষণ পরে মালতী তার দুষ্টামি ভরা হাসি হাসিল।
বৃষ্টি থামিল রাত্রি দশটার পর।
রাস্তায় কিছু কিছু জল দাঁড়াইয়া গিয়াছিল, জুতা ভিজাইয়া বাড়ির দিকে চলিতে চলিতে নিজেকে বড় নোংরা মনে হইতে লাগিল রাজকুমারের। পথের সমস্ত ময়লা যেন জলে ধুইয়া তারই পায়ে লাগিতেছে।
গলির মধ্যে তার বাড়ির সামনে শ্যামলকে দাঁড়াইয়া থাকিতে দেখিয়া রাজকুমার ঠিক আঘাত পাওয়ার মতোই চমক বোধ করিল। এখনন শ্যামলের জামাকাপড় ভিজিয়া চপ্ চপ্ করিতেছে। মালতীর বাড়ি হইতে বাহির হইবার পর হইতে এতক্ষণ সে কি এখানে দাঁড়াইয়া আছে? অথবা বাড়ি হইতে শুকনো জামাকাপড় পরিয়া আসিয়া আবার জলে ভিজিয়াছে?
আপনার সঙ্গে একটা কথা আছে রাজকুমারবাবু।
এস না, ভেতরে এস।
না, এখানে দাঁড়িয়েই বলি।
রাজকুমার একটু রাগ করিয়া বলিল, শ্যামল, মালতীর কথা বলবে বুঝতে পারছি, কিন্তু ভিজে কাপড়ে জলকাদায় দাঁড়িয়ে না বললে কি চলবে না তোমার? এমন ছেলেমানুষ তো তুমি ছিলে না, কি হয়েছে তোমার আজকাল?–বলিয়া রাজকুমার দরজার কড়া নাড়িল।
দরজা খুলিবার সময়টুকুর মধ্যে শ্যামল একবার কয়েক পা আগাইয়া আবার আগের জায়গায় গিয়া দাঁড়ায়। যেন ঠিক করিতে পারিতেছে না রাজকুমারের বাড়িতে ঢুকিবে কি ঢুকিবে না। ভিতরে গিয়া তাকে রাজকুমারের একবার ডাকিতে হয়।
শ্যামল আগেও কয়েকবার রাজকুমারের কাছে আসিয়াছে, মনোরমা তাকে চিনিত। তাকে। দেখিবামাত্র সে বলিয়া ওঠে, ভিজে চুপচুপে হয়ে এত রাতে তুমি কোথা থেকে এলে ভাই? ও কালী, কালী, তোর রাজুদার ঘর থেকে একখানা শুকনো কাপড় এনে দে শিগগির।
গিরির সমবয়সী একটি মেয়ে আসিয়া দাঁড়ায়। গিরির চেয়ে তার স্বাস্থ্য ভালো, বোধহয় সেইজন্যই তার মুখে কচি ডাবের খানিকটা স্নিগ্ধ লাবণ্য আছে। মনোরমার তাগিদ সহিতে না। পারিয়া রাজকুমার সরসীর সভার পরদিন সকালে দক্ষিণেশ্বর গিয়া কালীকে নিয়া আসিয়াছে।
রাজকুমারের সঙ্গে এত বড় (বার-তের কম বয়স নয় গৃহস্থ মেয়েদের) মেয়েকে পাঠানো সম্বন্ধে নিশ্চিন্ত করিয়া মনোরমা আগেই মাসির কাছে পত্ৰ দিয়াছিল, তবু কালীর মা, মেয়েকে একা ছাড়িয়া দিতে সাহস পায় নাই। কালীর সঙ্গে তার সাত বছরের একটি ভাইও আসিয়াছে।
কালী বলে, কি দিদি?
মনোরমা বলে, বললাম যে? শুকনো কাপড় নিয়ে আয় রাজুদার ঘর থেকে।
মনোরমার উদারতায় মনে মনে রাজকুমারের হাসি পায়। শ্যামলের জামাকাপড় ভিজিয়া গিয়াছে, আহা, অসুখ যদি করে ছেলেটার?–ভাবিয়া বড় ব্যাকুল হইয়াছে কিনা মনোরমা, তাই হাতের কাছে আলনাতে স্বামীর শুকনো কাপড় আনাতেই থাক, রাজকুমারের ঘর হইতে কাপড় আনা হোক একখানা কালীকে দিয়া। এত হিসাব করিয়া অবশ্য মনোরমা কথাটা বলে নাই। তার মনেও আসে নাই এ মানে। এটা শুধু অভ্যাস।
থাক, আমার ঘরে গিয়েই কাপড় ছাড়বেখন। বলিয়া শ্যামলকে নিয়া রাজকুমার ঘরে চলিয়া যায়।
কালী মুচকি মুচকি হাসিতেছে দেখিয়া মনোরমা রাগের সুরে বলে, হাসছিস যে?
কালী তেমনি ভাবে হাসিতে হাসিতেই বলে, তুমি যেন কি দিদি!–বলিয়া এক দৌড় দেয়। ঘরের মধ্যে, সেখানে তার মুচকি হাসি শব্দময় হইয়া ওঠে।