কিন্তু মন মানে নাই রাজকুমারের। উপাচকের কলঙ্ক জুটিবার ছেলেমানুষি ভয়ের জন্য নয়, এই কলঙ্ক যে আরোপ করিবে তারই ভয়ে। যে জটিল সম্পর্ক দাঁড়াইয়াছে ওদের সঙ্গে তার জট খুলিবে না, কেউ সহজ হইতে পারিবে না। একা থাকিতে না পারিয়া সে ছুটিয়া আসিয়াছে বটে কিন্তু এ একাকিত্ব যে তার কাছে অর্থহীন, দুর্বোধ্য রহস্যের মতে, কাছে বসিয়া কথা বলিলে, কাছে আসিয়া এক হওয়ার খেলা খেলিলে যে এই একাকিত্বের দুঃখ তার ঘুচিবে না, এ সত্য অন্যের কাছে কোনোমতেই সত্য হইয়া উঠিবে না। মানুষ দুটি থাকিবে আড়ালে, একের সভ্যতা শুধু পীড়ন করিবে অপরকে।
কেবল মালতীর কাছে যাওয়ার একটা বাস্তব অজুহাত আছে। মালতীও অনেক কিছু মনে করিবে সন্দেহ নাই, কিন্তু পীড়ন করার সুযোগ পাইবে না। বেতন পায় তাই বাদল অগ্রাহ্য করিয়া পড়াইতে আসিয়াছে, এই বর্ম গায়ে আঁটিয়া কিছুক্ষণ মালতীর সঙ্গে কাটাইতে পারিবে। তা ছাড়া, কথা আর হাসি ওখানে দরকার হইবে না, বাড়তি অস্বস্তির যন্ত্রণা জুটিবে না। পড়ানো তার কাজ– বেতনভোগীর নিছক কর্তব্য পালন করা। সেটুকু করিলেই চলবে।
বাহিরে আবার যখন বৃষ্টি নামিল, ঘরের মধ্যে রাজকুমার বোধহয় তখন ভুলিয়াই গেল কোথায় বসিয়া কাকে সে পড়াইতেছে। শুকনো কথার শব্দ জলের শব্দে খানিকটা চাপা পড়িয়া গেল। ভালো করিয়া শুনিবার জন্য টেবিলের উপর হাত রাখিয়া মালতী সামনের দিকে আরো ঝুঁকিয়া বসিল।
রাজকুমার হঠাৎ থামিয়া গেল, সন্দেহ প্রকাশ করিয়া বলিল, তুমি কিছু শুনছ না মালতী।
শুনছি। সত্যি শুনছি। কি করে জানলেন শুনছি না?
আমি জানতে পারি।
মালতী নীরবে আস্তে আস্তে কয়েকবার মাথা নাড়িল। অর্থাৎ সেটা সম্ভব নয়, কিছু জানিবার ক্ষমতা রাজকুমারের নাই।
রাজকুমার শ্ৰান্তভাবে একটু হাসিল।–যাগ্গে, আজ পড়াতেও ভালো লাগছে না।
ভালো লাগছে না?
মালতী আশ্চর্য হইয়া জিজ্ঞাসু চোখ তুলিল। অর্থাৎ তাই যদি হয়, এতক্ষণ মশগুল হইয়া তুমি তবে কি করিতেছিলে?
রাজকুমার চেয়ারটা পিছনে ঠেলিয়া দিয়া উঠিয়া পাড়াইল। পুবের দেয়াল ঘেষিয়া দুটি বইভরা আলমারি অযথা গাম্ভীর্যের ভঙ্গিতে দাঁড়াইয়া আছে, রাজকুমারের মনের গাম্ভীর্যের রূপধরা ব্যঙ্গের মতো। হাজার মানুষের মনের যে গঞ্জনাকে প্রাণপণে সংগ্রহ করিয়া সে মনকে ভারি করিয়াছে, আলমারির এই বইগুলির চেয়ে তার ওজন কম নয়। চাপ দেওয়া ওজন-বুকের উপর বইগুলি স্তৃপ করিয়া রাখিলে শুধু কাগজের যে চাপে পাঁজর ভাঙিয়া যাইতে চাহিবে, অদেহী অক্ষরের পেষণ তার চেয়ে ভারি।
এক দিকের দুটি জানালাই খোলা। এদিক দিয়া ছাট আসে না। পাশের একতলা বাড়ির ফাঁকা ছাতে বৃষ্টি-ধারা আছড়াইয়া পড়িয়া গঁড়া হইয়া যাইতেছে। বইয়ের আলমারি ছাড়িয়া রাজকুমার জানালায় গেল, আবার ফিরিয়া আসিল।
এখন যাই মালতী।
বৃষ্টি পড়ছে যে?
তাই বটে, বৃষ্টি পড়িতেছে। মালতী যখন মনে পড়াইয়া দিয়াছে এখন বৃষ্টি মাথায় করিয়া চলিয়া যাওয়া অসম্ভব। মালতীর চেয়ারের পেছনে দাঁড়াইয়া রাজকুমার বলিল, নোট নিয়েছ?
চতুষ্কোণ টেবিলের অন্য তিন দিকের যেখানে খুশি দাঁড়াইয়া এ প্রশ্ন করা চলিত, মালতীর খাতাও দেখা চলিত। কিন্তু চতুষ্কোণ ঘরের মতোই চতুষ্কোণ টেবিলেও মাঝে মাঝে প্রান্তরের বিস্তৃতি পায়, এত দূর মনে হয় একটি প্রান্ত হইতে আরেকটি প্রান্ত।
মালতীর খোলা খাতার সাদা পৃষ্ঠা দুটিতে একটি অক্ষরও লেখা হয় নাই, দুটি পৃষ্ঠার যোগরেখার উপর লিখিবার কলমটি পড়িয়া আছে। রাজকুমার হাত বাড়াইয়া পাতা উল্টাইয়া দেখিতে গেল অন্য পৃষ্ঠায় কিছু লেখা আছে কিনা। তার বুকে লাগিয়া মালতীর মাথাটিও নত হইয়া গেল। রাজকুমারের আঙুলে তারের মতো সরু একটি আংটি, তাতে এক বিন্দু জলের মতো একটি পাথর। দুহাতে সেই আংটি পরা হাতটি শক্ত করিয়া চাপিয়া ধরিয়া আরো মাথা নামাইয়া আংটির সেই পাথরটিতে মুখ ঠেকাইয়া মালতী চুপ করিয়া পড়িয়া রহিল। সে যেন পিপাসায় কাতর, জলবিন্দুর মতো ওই পাথরটি পান করিয়াই পিপাসা মিটাইতে চায়।
তখন এক কোমল অনুভূতির বন্যায় রাজকুমারের চিন্তা আর অনুভূতির জগৎ ভাসিয়া গেল, মনে হইল শুধু মমতায় এবার তার মরণ হইবে। মালতীর একটি চুলের জন্য তার একি মায়া জাগিয়াছে! এক মুহূর্তের বেশি সহ্য করাও কঠিন এমন এই আত্মবিলোপ। মালতীকে বিশ্বজগতের রানী করিয়া দিলে তার সাধ মিটিবে না, ফুলের দুর্গে লুকাইয়া রাখিলে ভয় কমিবে না, তাই শুধু মালতী ছাড়া কিছুই সে রাখিতে চায় না, নিজেকে পর্যন্ত নয়।
কয়েক মুহূর্ত শ্ৰান্ত হইয়াই সে যেন ধীরে ধীরে মালতীর চুলে মাথা রাখিল।
মুখ তোল, মালতী।
মালতী মুখ তুলিল। তারপর ব্যস্তভাবে উঠিয়া সরিয়া গেল।
রাজকুমার বলিল, কি হয়েছে মালতী?
মালতী মৃদুস্বরে বলিল, শ্যামল এসেছে।
কোথায় শ্যামল?
মালতী ততক্ষণে খোলা দরজার কাছে আগাইয়া গিয়াছে। দরজার বাহিরে গিয়া সে ডাকিল, শ্যামল?
শ্যামল চলিয়া যাইতেছিল, বারান্দার মাঝখানে দাঁড়াইয়া পড়িল। জামাকাপড় তার ভিজিয়া। চুপসিয়া গিয়াছে! দরজার বাঁ দিকের আধভেজান জানালাটির নিচে মেঝেতে অনেকখানি জল জমিয়া আছে। শ্যামলের গা বাহিয়া তখনো জল পড়িতেছিল।
মালতী বলিল, এ কি ব্যাপার শ্যামল?
শ্যামল বলিল, একটা ফোন করতে এসেছিলাম। হঠাৎ বৃষ্টি নামল–
রাজকুমার আসিয়া দাঁড়াইল। সকলের আগে তার চোখে পড়িল জলে ভেজা শ্যামলের উদ্ভ্রান্ত ভাব। শিশু যেন হঠাৎ ভয় পাইয়া দিশেহারা হইয়া গিয়াছে।