রাজকুমার চুপ করিয়া শুনিতেছিল এবং ভাবিতেছিল, এইবার সে উঠিয়া দাঁড়াইল। সব সময় তার মুখে যে মৃদু একটু বিবৰ্ণতার ছাপ থাকে, রাগে এখন তাহা মুছিয়া গিয়াছে। তবু সে শান্ত কণ্ঠেই বলিল, আমার কথা তুমি ঠিক বুঝতে পারনি শ্যামল। আমি বলেছি অন্য প্রদেশের চেয়ে মাদ্রাজের মেয়েরা পরিবর্তনকে গ্রহণ করছে একটু ব্যাপকভাবে, সামান্য হলেও তার ব্যাপ্তি আছে। বাংলায় মেয়েদের খুব সামান্য একটা অংশ অনেক এগিয়ে গেছে, তাদের সংখ্যা এত কম যে ধর্তব্যের মধ্যেই বলা চলে না। বাকি সকলে অর্থাৎ বাংলাদেশের মেয়ে বলতে যাদের বোঝায় তারা পড়ে আছে একেবারে পিছনে। মাদ্রাজের মেয়েদের একটা ক্ষুদ্র অংশবিশেষ এভাবে এগিয়ে না গিয়ে সকলে মিলে অল্প অল্প অগ্রসর হচ্ছে। ব্যাপারটা কেমন হয়েছে জান, বাংলায় একটুখানি নারীপ্রগতি যেন সঞ্চিত হয়েছে কাচের সরু নলে, গভীরতা আছে কিন্তু ব্যাপ্তি নেই আর মাদ্রাজের নারী প্রগতিটুকু সঞ্চিত হয়েছে থালায়, গভীরতা নেই কিন্তু বিস্তার আছে। আমি মনে করি, মৃতদেহের একটা আঙুল প্রাণ পেয়ে যতই তিড়িং তিড়িং করে লাফিয়ে জীবনের প্রমাণ দিক, তার চেয়ে সর্বাঙ্গে একটুখানি প্রাণ সঞ্চার হয়ে শরীরটা যদি এক ডিগ্রিও গরম হয়, তাও অনেক ভালো।
রাজকুমার ধপ্ করিয়া বসিয়া পড়িল। তার ডবল উপমার ধাক্কায় শ্যামলের এতক্ষণের বড় বড় কথাগুলি যেন ধুলা হইয়া বাতাসে উড়িয়া গেল।
কিন্তু শ্যামল তখন মরিয়া হইয়া উঠিয়াছে। রাজকুমারকে জব্দ করিতে উঠিয়া নিজে জব্দ হইয়া আসন গ্রহণ করার মতো মানসিক অবস্থা তার ছিল না। প্রাণপণ চেষ্টায় একটু অবজ্ঞার হাসি হাসিয়া সে বলিতে গেল, রাজকুমারবাবু যে সব–
রিণি তীক্ষকণ্ঠে জিজ্ঞাসা করিল, আপনি কখনো মাদ্রাজে গেছেন শ্যামলবাবু?
শ্যামল দমিয়া গেল, আমতা আমতা করিয়া বলিল, আমি–? না, যাই নি।
ও! কিছু মনে করবেন না, এমনি জিজ্ঞেস করছিলাম।
শ্যামল বোধহয় আরো কিছু বলিতে যাইতেছিল সুযোগ পাইল না। পাঞ্জাবির ডানদিকের পকেটে তার এমন জোরে টান পড়িল যে আপন হইতেই সে বসিয়া পড়িল।
মালতী বলিল, চুপ করে বসে থাকুন।
কেন? আমার যা বলবার আছে—
চুপ। একটি কথা নয়। মুখ বুজে বসে থাকুন।
না বস্ব না। আমি যাই।
বসে থাকুন। সকলের সঙ্গে যাবেন।
মালতীর চাপা গলার তীব্র ধমকে শ্যামল যেন শিথিল, নিস্তেজ হইয়া গেল।
তারপর রিণি যখন সভাশেষের গান ধরিয়াছে, মেয়েরা মৃদুস্বরে নিজেদের মধ্যে কথা আরম্ভ করিয়াছে, মাদ্ৰাজী মেয়েটির সঙ্গে সরসী রাজকুমারের পরিচয় করাইয়া দিল। মেয়েটির নাম রুক্মিণী, সরসীর সঙ্গে পড়িত। এখন নিজে আর পড়ে না, একটি স্কুলে মেয়েদের পড়ায়।
আপনি সুন্দর বলেছেন। রাজকুমার সবিনয়ে হাসিল।
আমি ভাবছিলাম একজন বাঙালি ভদ্রলোক আমাদের দেশের মেয়েদের সম্বন্ধে বলবেন, এ তো ভারি আশ্চর্য, আমাদের দেশের মেয়েদের কথা তিনি ভালো করে জানবেন কি করে? খুব। আগ্রহ নিয়ে তাই আপনার কথা শুনতে এসেছিলাম। ভারি খুশি হয়েছি আপনার বক্তৃতা শুনে। কেবল একটা কথা দ্বিধা ও সঙ্কোচের ভঙ্গিতে রুক্মিণী এতক্ষণ ইতস্তত করিল যে রাজকুমারের মনে হইল কথাটা বুঝি শেষ পর্যন্ত না বলাই সে ঠিক করিয়াছে–একটা কথা জিজ্ঞাসা করি আপনাকে। আচ্ছা, মাদ্রাজের দু-চার জন মেয়েও কি বাংলার কাচের নলের মেয়েদের–মানে, যারা খুব এগিয়ে গেছেন তাদের সমান হতে পারেন নি?
রাজকুমার ব্যস্ত হইয়া বলিল, তা পেরেছেন বৈকি, অনেকেই পেরেছেন।
রুক্মিণী খুশি হইয়া বলিল, থ্যাঙ্কস।
তাই বটে। একজন মাদ্ৰাজী মেয়েও যদি চরম-কালচারী বাঙালি মেয়েদের সমান না হইতে পারিয়া থাকে, রুক্মিণী তবে দাঁড়ায় কোথায়? রাজকুমার মনে মনে ভাবিল, রুক্মিণী মেয়েটি বেশ।
সকলের আগে স্যার কে. এল বিদায় নিলেন। তাঁর অম্বলের অসুখ, লাইট রিফ্রেশমেন্টও সহ্য হইবে না। তাছাড়া, এই সব ছেলেমানুষের সভায় যদি বা এতক্ষণ থাকা গিয়াছিল, সভা এখন বৈঠকে পরিণত হইয়াছে, এখন আর থাকা চলে না। তাঁর কাজও আছে।
রাজকুমার বলিল, চলুন আমিও আপনার সঙ্গে যাই।
পথে স্যার কে. এল আপন মনেই নিঃশব্দে হাসিতে লাগিলেন, উপভোগ্য একটা রসিকতার রস যেন মন হইতে তার কিছুতেই মিলাইয়া যাইতেছে না।
অনেকদিন আগে এমনি একটা আসরে উপস্থিত ছিলাম রাজু। বিলাতে।
এমনি আসর?
অবিকল এই রকম। ইয়ং বয়েজ অ্যাণ্ড গার্লস্। আমার মতোই একজন আধুবুড়োকে। প্রেসিডেন্ট করেছিল। একটা ব্যাপার লক্ষ করেছ রাজু। অল্পবয়সী ছেলেমেয়েরা সভা করে। কিন্তু প্রেসিডেন্ট করে বুড়োকে? কম বয়সী কাউকে প্রেসিডেন্ট করতে বোধহয় তাদের হিংসা হয়। কিংবা হয়ত প্রেসিডেন্ট বলতেই এমন একটা গম্ভীর জবরদস্ত মানুষ বোঝায় যে বুড়ো ছাড়া প্রেসিডেন্টের আসনে কাউকে বসাবার কথা তারা ভাবতেও পারে না।
রাজকুমার হাসিল। –বর্ণনাটা কিন্তু আপনার সঙ্গে ঠিক খাপ খায় না।
স্যার কে. এলও হাসিলেন। কিছু কিছু খাপ খায় বৈকি। বয়স তো হয়েছে, আমি হলাম অতীতের জীব, তোমাদের কাছে আমি বুড়ো, স্থিতি লাভ করেছি। আমাকে প্রেসিডেন্টের আসনে বসিয়ে নিশ্চিন্ত মনে চপলতা করা কত সুবিধা বল তো!
চপল স্যার কে. এল?
চপল রাজু, নিছক চপলতা। তোমাদের কপাল ভালো, এত সহজে এত সস্তায় চপল হতে পার। আমার আধ বোতল শ্যাম্পেন দরকার হয়, তিন চারটা ককটেল। তাও কি তোমাদের মতো চপলতা আসে! হয় দার্শনিক চিন্তা আসে, নয় ঘুম পায়।