দেখিয়া শ্যামলের মাথা গরম হইয়া গেল।
–আমার কথা শুনে আপনারা অনেকেই ক্ষুণ্ণ হবেন। আমাকে … কয়েকটি অপ্রিয় সত্য কথা বলতে হবে। বিশ্বনারী বা মাদ্রাজী মহিলাদের সম্বন্ধে নতুন কিছু আপনাদের শোনাবার জন্য আমি উঠে দাঁড়াই নি, রাজকুমারবাবুর বক্তৃতার কয়েকটা মারাত্মক ভুল দেখিয়ে দেওয়া আমার। উদ্দেশ্য। ব্যক্তিগতভাবে রাজকুমারবাবুকে আমি শ্ৰদ্ধা করি, উনি আমার অনেক দিনের বন্ধু–
রাজকুমারের মুখে আর হাসির চিহ্নও ছিল না। কি সৰ্বনাশ, এতগুলি লোকের সামনে তাকে অপদস্থ করার জন্য শ্যামল উঠিয়া দাঁড়াইয়াছে। নিরীহ শান্ত ভালেমানুষ শ্যামল! রাজকুমারের কোনো সন্দেহই ছিল না যে সে অনেক ভুল করিয়াছে। এখন তার আতঙ্ক জন্মিয়া গেল যে ভুলগুলি নিশ্চয় সাধারণ তুচ্ছ ভুল নয়, শ্যামল চোখে আঙুল দিয়া ভুলগুলি দেখাইয়া দিলে তার আর মাথা উঁচু করিয়া বসিয়া থাকিবার উপায় থাকিবে না। সাংঘাতিক হাস্যকর ভুল না হইলে শ্যামল কি সাহস করিয়া মুখ খুলিতে পারি? না জানি কি ভাবিবে সকলে, মনে মনে কত হাসিবে, তার জ্ঞান বুদ্ধি অভিজ্ঞতার খোলসটা যখন শ্যামল ছিড়িয়া ফেলিতে থাকিবে। রাজকুমারের সর্বাঙ্গ ঘামিয়া গেল। এতদিন সে জানি, তার সম্বন্ধে মানুষ কি ধারণা পোষণ করে সে বিষয়ে তার কিছুমাত্র মাথাব্যথা নাই, এই সমস্ত অল্পবুদ্ধি অগভীর নরনারীর মতামতকে সে গ্রাহ্য করে না। এক মুহূর্ত আগেও সে নিজের কাছে স্বীকার করিত না বক্তৃতা না জমিলে মন তার খারাপ হইয়া যাইবে। এখন শ্যামলের উদ্যত আঘাতে নিজের বাহাদুরির প্রাসাদ ভাঙিয়া পড়ার উপক্রম করিয়াছে দেখিয়া সে বুঝিতে পারিল, লোকে তাকে কি ভাবে তা কত দামি তার নিজের কাছে। অবজ্ঞার ভয়ে মরণ কামনা করার মতো দামি সকলের তাকে বাহাদুর মনে করা।
রাজকুমারের অপরিচিত একটি মেয়ে উঠিয়া দাঁড়াইয়াছিল, দেখিলেই বোঝা যায় সে খাঁটি মাদ্ৰাজী মেয়ে। আর দশজন মেয়ের মধ্যে বসিয়াছিল বলিয়া এতক্ষণ সে রাজকুমারের নজরে পড়ে নাই, আসরে খাঁটি একজন মাদ্ৰাজী মেয়ে উপস্থিত আছে জানিলে রাজকুমারের বক্তৃতাটা আজ কি রকম দাঁড়াইত কে জানে!
মেয়েটি বলিল, রাজকুমারবাবু নিজের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথাই বলেছেন। ভুল দেখিয়ে দেবার প্রশ্ন ওঠে কি? এটা ডিবেটিং সোসাইটির মিটিং নয় আশা করি?
সকলে মুখ চাওয়া-চাওয়ি করিতে লাগিল। ঠিক তো, রাজকুমার যাই বলিয়া থাক, তার বক্তৃতায় সমালোচনা করিবার কি অধিকার শ্যামলের আছে?
স্যার কে. এল হাসিমুখে বলিলেন, শ্যামল রাজকুমারের ভুল দেখিয়ে দিচ্ছে না, আমাদের যাতে ভুল ধারণা না জন্মায় সেজন্য নিজের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা বলছে। কি বল শ্যামল?
শ্যামল তাড়াতাড়ি বলিল, আজ্ঞে হ্যাঁ। যেমন ধরুন রাজকুমারবাবু বিশ্বের নারীজাতির বিস্ময়কর মিলের কথা বলেছেন। পৃথিবীর যে কোনো একটি দেশের পুরুষের সঙ্গে অন্য যে কোনো একটি দেশের পুরুষের যতটা পার্থক্য দেখা যায়, দুটি দেশের মেয়েদের পার্থক্য নাকি তার চেয়ে অনেক কম। কথাটা কি ঠিক? আমাদের দেশের পুরুষরা যখন বিলিতি পুরুষদের সাজপোশাক চালচলন অনুকরণ করে তখন অতটা খারাপ দেখায় না, কিন্তু মেয়েরা ওদেশের মেয়েদের অনুকরণ করলে সেটা উদ্ভট আর হাস্যকর হয়ে দাঁড়ায়। ভারতীয় পুরুষ সহজেই সাজপোশাক চালচলনে তো বটেই, প্রকৃতিতে পর্যন্ত সায়েব হতে পারে, কিন্তু ভারতীয় মেয়েরা কোনোদিন মেমসায়েব হতে পারে না। রাজকুমারবাবু যে বিশ্বের নারীজাতির কথা বলেছিলেন তার কারণ বিশ্ব শব্দের একটা মোহ আছে, প্রথমে সকলে বিশ্বের কথাটা মনে পড়িয়ে দিলে সকলের মন উদার হয়ে যায়, বাজে কথাও সকলে বড় বড় অর্থে গ্রহণ করে। ও একটা প্যাচ ছাড়া কিছু নয়। রাজকুমারবাবু
মাদ্ৰাজী মেয়েটি আবার উঠিয়া দাঁড়াইয়া প্রতিবাদ জানাইল, এটা কি ব্যক্তিগত আক্রমণ হচ্ছে না?
স্যার কে. এল হাসিমুখেই সায় দিয়া বলিলেন, খানিকটা হচ্ছে বৈকি!
শ্যামল জোর দিয়া বলিল, না না, ব্যক্তিগত আক্রমণ হবে কেন, রাজকুমারবাবুর সঙ্গে তো আমার শত্রুতা নেই! আমি বলছিলাম, মাদ্রাজের নারীদের অবস্থা সম্বন্ধে রাজকুমারবাবুর ধারণা খুব স্পষ্ট নয়, তিনি তাই বিশ্বের নারীজাতির কথা তুলেছিলেন, সমগ্ৰতার অস্পষ্টতায় যাতে খুঁটিনাটির অভাবটা চাপা পড়ে যায়। মাদ্রাজের নারীরাও বিশ্বের নারীজাতির অন্তর্গত বৈকি! মাদ্রাজের নারীদের সম্বন্ধে রাজকুমারবাবু যে সব কথা বলেছেন তার অধিকাংশ বিশ্বের যে কোনো দেশের নারীজাতির সম্বন্ধে বলা যায়। মাদ্ৰাজী মেয়েদের একটিমাত্র বৈশিষ্ট্যের কথা রাজকুমারবাবু স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছেন, যুগোপযোগী সংস্কারকে অত্যন্ত সহজে গ্রহণ করবার অশিক্ষিতপটুতা তাদের নাকি। বিস্ময়কর। স্কুল-কলেজের শিক্ষার হিসাবে তারা নাকি ভারতের অন্যান্য প্রদেশ, বিশেষ করে বাংলার তুলনায় অনেক পিছনে পড়ে আছেন, কিন্তু জীবনযাত্রাকে নতুন ছাঁচে ঢালবার চেষ্টায় সব প্রদেশকে হার মানিয়েছেন। এ ধারণা রাজকুমারবাবু যে কোথায় পেলেন কল্পনা করা কঠিন। মাদ্রাজের মেয়েরা তাদের সামাজিক ও পারিবারিক জীবনে বিশেষ কোনো সংস্কারের আমদানি করেছেন, অথবা ও বিষয়ে তাঁদের উল্লেখযোগ্য উৎসাহ দেখা গিয়েছে বলে তো মনে হয় না। নতুন আলো চোখে লাগা আর সেই আশোয় নতুন দৃষ্টিতে জীবনকে যাচাই করার অসুবিধা ও সুযোগের অভাব অন্য সব প্রদেশের মতো মাদ্রাজের মেয়েদেরও কিছুমাত্র কম নয়।