- বইয়ের নামঃ চতুষ্কোণ
- লেখকের নামঃ মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
- প্রকাশনাঃ অবসর প্রকাশনা সংস্থা
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস
০১. বেলা তিনটার সময় রাজকুমার টের পাইল
বেলা তিনটার সময় রাজকুমার টের পাইল, তার মাথা ধরিয়াছে। এটা নূতন অভিজ্ঞতা নয়, মাঝে মাঝে তার ধরে। কেন ধরে সে নিজেও জানে না, তার ডাক্তার বন্ধু অজিতও জানে না। তার চোখ ঠিক আছে, দাঁত ঠিক আছে, ব্লডপ্রেসার ঠিক আছে, হজমশক্তি ঠিক আছে–শরীরের সমস্ত কলকজাগুলিই মোটামুটি এতখানি ঠিক আছে যে, মাঝে মাঝে মাথাধরার জন্য তাদের কোনোটিকেই দায়ী করা যায় না। তবু মাঝে মাঝে মাথা ধরে।
অজিত অবশ্য এক জোড়া কারণের কথা বলিয়াছে : আলসেমি আর স্বাস্থ্যরক্ষার রীতিনীতিতে অবহেলা। রাজকুমার তার এই ভাসা ভাসা আবিষ্কারে বিশ্বাস করে না। প্রথম কারণটা একেবারেই অর্থহীন, সে অলস নয়, তাকে অনেক কাজ করিতে হয়। দ্বিতীয় কারণটা যুক্তিতে টেকে না, স্বাস্থ্যরক্ষার রীতিনীতি না মানিলে স্বাস্থ্য খারাপ হইতে পারে, মাথা ধরিবে কেন?
অজিত খোঁচা দিয়ে বলিয়াছেন, তোর স্বাস্থ্য খুব ভালো, না?
অসুখে ত ভুগি না।
মাথাধরাটা–
মাথাধরা অসুখ নয়।
মাথা খারাপ হওয়াটা?
আজ গোড়াতেই মাঝে মাঝে সাধারণ মাথাধরার সঙ্গে আজকের মাথাধরার তফাতটা রাজকুমার টের পাইয়া গেল। দু-চার মাস অন্তর তার এরকম খাপছাড়া মাথাধরার আবির্ভাব ঘটে। নদীতে জোয়ার আসার মতো মাথায় একটা ভোঁতা দুর্বোধ্য যন্ত্রণার সঞ্চার সে স্পষ্ট অনুভব করিতে পারে, তারপর বাড়িতে বাড়িতে পরিপূর্ণ জোয়ারের মতো যন্ত্রণাটা মাথার মধ্যে থমথম করিতে থাকে। অনেক রাত্রি পর্যন্ত ঘুম আসে না। মাথাধরা কমানোর ওষুধে শুধু যন্ত্রণার তীব্রতা বাড়ে, ঘুমের ওষুধে যন্ত্রণাটা যেন আরো বেশি ভোঁতা আর ভারি হইয়া দম আটকাইয়া দিতে চায়।
খাটের বিছানায় তিনটি মাথার বালিশের উপর একটি পাশবালিশ চাপাইয়া আধশোয়া অবস্থায় রাজকুমার বসিয়া ছিল। তৃষ্ণায় মুখ শুকাইয়া গিয়াছে। মাথা ধরিলে রাজকুমারের এরকম হয়। সাধারণ জল, ডাবের জল, শরবৎ কিছুতেই তার তৃষ্ণা মেটে না। এটাও তার জীবনের একটা দুর্বোধ্য রহস্য। শুকনো মুখের অপ্রাপ্য রস গিলিবার চেষ্টার সঙ্গে চাষার গরু তাড়ানোর মতো একটা আওয়াজ করিয়া সে সোজা হইয়া উঠিয়া বসিল।
চারকোনা মাঝারি আকারের ঘর, আসবাব ও জিনিসপত্রে ঠাসা। এই ঘরখানাই রাজকুমারের শোয়ার ঘর, বসিবার ঘর, লাইব্রেরি, গুদাম এবং আরো অনেক কিছু। অনেক কালের পুরোনো। খাটখানাই এক-চতুর্থাংশ স্থান–আরো একটু নিখুঁত হিসাব ধরিলে ৪৫৭/১৭৭৬, স্থান, রাজকুমার একদিন খেয়ালের বশে মাপিয়া দেখিয়াছে–দখল করিয়া আছে। বই বোঝই তিনটি আলমারি ও একটি টেবিল, দাড়ি কমানোর সরঞ্জাম, ওষুধের শিশি, কাচের গ্লাস, চায়ের কাপ, জুতোপালিশের কৌটা, চশমার খাপ প্রভৃতি অসংখ্য খুঁটিনাটি জিনিসে বোঝাই আরেকটি টেবিল, তিনটি চেয়ার, একটি ট্রাঙ্ক এবং দুটি বড় ও একটি ছোট চামড়ার সুটকেস, ছোট একটি আলনা, এ সমস্ত কেবল পা ফেলিবার স্থান রাখিয়া বাকি মেঝেটা আত্মসাৎ করিয়াছে।
তবে রাজকুমার কোনোরকম অসুবিধা বোধ করে না। এ ঘরে থাকিতে তার বরং রীতিমতো আরাম বোধ হয়। ঘরখানা যেমন জিনিসপত্রে বোঝই, তেমনি অনেক দিনের অভ্যাস ও ঘনিষ্ঠতার স্বস্তিতেও ঠাসা।
এই ঘরে মাথাধরার যন্ত্ৰণা সহ্য করিবার মধ্যেও যেন মৃদু একটু শান্তি আর সান্ত্বনার আমেজ আছে। জগতের কোটি কোটি ঘরের মধ্যে এই চারকোনা ঘরটিতেই কেবল নির্বিকার অবহেলার সঙ্গে গা এলাইয়া দিয়া সে মাথার যন্ত্রণায় কাবু হইতে পারে।
মাথাধরা বাড়িবার আগে এবং স্থায়ীভাবে গা এলানোর আগে কয়েকটি ব্যবস্থা করিয়া ফেলা দরকার। মনে মনে রাজকুমার ব্যবস্থাগুলির হিসাব করিতে লাগিল। রসিকবাবুর বাড়ি গিয়া গিরীন্দ্রনন্দিনীর মাকে বলিয়া আসিতে হইবে, আজ রাত্রে তাদের বাড়ি খাওয়া অসম্ভব। অবনীবাবুর বাড়ি গিয়া মালতীকে বলিয়া আসিতে হইবে, আজ সে তাকে পড়াইতে যাইতে পারিবে না। স্যার কে. এল-এর বাড়ি গিয়া রিণিকে বলিয়া আসিতে হইবে, আজ তার সঙ্গে কারো পাটিতে যাওয়া বা জলতরঙ্গ বাজনা শোনানোর ক্ষমতা তার নাই। কেদারবাবুর বাড়ি গিয়া সরসীকে বলিয়া আসিতে হইবে, সমিতির সভায় গিয়া আজ সে বক্তৃতা দিলে, সকলে শুধু উঃ আঃ শব্দই শুনিতে পারবে। রাজেনকে একটা ফোন করিয়া দিতে হইবে, কাল সকালে কাজে ফাঁকি না দিয়া তার উপায় নাই।
এই কাজগুলি শেষ করিতে বেশিক্ষণ সময় লাগিবে না, গিরি, মালতী, রিণি আর সরসী চার জনের বাড়িই তার বাড়ির খুব কাছে, একরকম পাশের বাড়িই বলা যায়। পশ্চিমে বড় রাস্তার ধারে স্যার কে. এল-এর প্রকাণ্ড বাড়ির পিছনে তার বাড়িটা আড়ালে পড়িয়া গিয়াছে, স্যার কে. এল-এর বাড়ির পাশের গলি দিয়া ঢুকিয়া তার বাড়ির সদর দরজায় পৌঁছিতে হয়। উত্তরে গলির মধ্যে তার বাড়ির আর দিকে কেদারবাবুর বাড়ি। পুবে গলির মধ্যে আর একটু আগাইয়া গেলে ডান দিকে যে আরো ছোট গলিটা আছে তার মধ্যে ঢুকিলেই বাঁ দিকে অবনীবাবুর বাড়ি। দক্ষিণে ছোট গলিটা ধরিয়া খানিক আগাইয়া ডান দিকে হঠাৎ মোড় ঘুরিবার পর রসিকবাবুর বাড়ি এবং গলিটারও সেইখানে সমাপ্তি। রিণি আর সরসী দুজনের বাড়িতেই ফোন আছে, রাজেনকে ফোন করিতেও হাঙ্গামা হইবে না।