বিলিতি জাহাজ কোম্পানি ফ্লোটিলার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে খুলনা বরিশাল জলপথে ফেরি চালাবেন তিনি। দিশি লোকেরা দিশি জাহাজে চড়তেই নিশ্চয় পছন্দ করবে, জ্যোতির জাহাজ উদবোধনের দিন ঠিক হয়েছে ১৯ এপ্রিল। ১৮৮৪ সালের এই দিনটি বাঙালির জাহাজ ব্যাবসার ইতিহাসে সোনার জলে লেখা থাকবে। জ্যোতি বুঝতে পারেননি, ওটাই হয়ে উঠবে তাঁর জীবনের সবচেয়ে অন্ধকার দিন।
১৯ এপ্রিলের জন্য মহা তোড়জোড় শুরু হয়ে গেল। শহরের গণ্যমান্য ব্যক্তিদের আমন্ত্রণ করা হয়েছে সেদিন উপস্থিত থাকার জন্য। হয়তো বড়লাট আসবেন, জ্যোতির বিশেষ ইংরেজ-প্রীতি না থাকলেও হোমরাচোমরা সাহেবরা না এলে জাহাজের তেমন প্রচার হবে না। বাঙালির জাহাজ ব্যাবসার টানে প্রেস আসবে, কিন্তু গোরাসাহেবদের রিঅ্যাকশন দেখতে ঝাঁপিয়ে পড়বে।
উদবোধন উপলক্ষে জ্ঞানদা তার নিজের ও বিবি-সুরেনের জন্য বিশেষ পোশাক তৈরি করতে দিয়েছেন। বাড়িতে দরজি বসেছে। কিন্তু জ্যোতির পোশাক নিয়েই তার বেশি চিন্তাভাবনা। বিলিতি দোকানের স্যুট কিনবেন, না রাজকীয় চোগা-চাপকান-পাগড়িতে সাজাবেন তাকে। অবশ্য জ্যোতি যা পরেন তাকে চমৎকার মানায়। বড়বাজারের পাঞ্জাবি শালওয়ালা এসেছে নানারকম জরি-কিংখাবের ছিটকাপড় নিয়ে। তার থেকেই জ্যোতি আর রবির জন্য কাপড় বেছে চাপকান করতে দিলেন শেষে।
এ-সব হুলুস্থুল তোড়জোড় থেকে অনেক দূরে বর্ষার মেঘের মতো একঢাল খোলা চুল ছড়িয়ে একা একা বসে আছেন কাদম্বরী। জ্যোতির ওপর তার তীব্র অভিমান, জাহাজের উদবোধনের কোনও কর্মকাণ্ডে স্বামী তাঁকে জড়াননি, সব ছেড়ে দিয়েছেন মেজোবউঠানের হাতে, যে মেজোবউ এর কাদম্বরী চক্ষুশূল। বাড়ি আসেন না, কোথায় কোথায় রাত কাটান, সব সহ্য করছি, ভালবাসা কি এতটাই ক্ষয়ে গেল যে কাজের সঙ্গিনী হওয়ার মর্যাদাটুকুও কেড়ে নিতে হবে!
জ্যোতি তাকে বলেছেন, একেবারে উদবোধনের দিন জাহাজে নিয়ে গিয়ে চমকে দেবেন। সে চমক কে চায়, তিনি তো চেয়েছিলেন সেই কাজে সহযোগী হতে। কেন, কেন এই অবহেলা? সেদিনের মধুরজনী কি আর ফিরে আসবে না?
তবু কাদম্বরী প্রস্তুতি নিচ্ছেন। বিশু তাঁতিনিকে ডেকে নতুন একটি কমলারঙা স্বর্ণচরী শাড়ি বেছেছেন উদ্বোধনে পরার জন্য, গয়না বেছে বেছে আয়নার সামনে পরে দেখছেন। সেদিন শুধু জ্যোতিই তাকে চমক দেবেন তা হয় না, কাদম্বরীও চমকে দেবেন জ্যোতিকে।
জীবনের সেরা সাজ সাজবেন তিনি, জ্ঞানদাকে হারিয়ে দেবেন রূপের উজ্জ্বলতায়। যখন জাহাজের ডেকে গিয়ে দাঁড়াবেন, লোকের চোখ তাকেই ঘুরেফিরে দেখবে। জ্ঞানদা তার চেয়ে অনেক সৌভাগ্যবতী হতে পারেন, কিন্তু রূপে ও সংবেদনায় তার ধারেকাছে আসতে পারবেন না, জানেন কাদম্বরী। ঠাকুরবাড়ির অন্দরে সেকথা চালু আছে। সেই রাগেই হয়তো মেজোবউ জ্যোতিকে তাঁর কাছ থেকে কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা করেন।
জ্যোতির খুব ইচ্ছে ছিল বিনোদিনীকে নিয়ে আসবেন অনুষ্ঠানে, কিন্তু বিনোদিনী রাজি না। বিনোদিনীর উপস্থিতি ছাড়া জ্যোতি তার জাহাজের উদবোধন করতে চান না। কী উপায় করা যায় ভাবতে ভাবতেই তড়িঘড়ি বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলেন জ্যোতি।
কাদম্বরী ঘরে বসে থোপানিকে কাপড় দিচ্ছিলেন। অভ্যেসমতো জ্যোতির জোব্বার পকেটে হাত দিয়ে কাগজপত্র বার করতে গিয়ে তার হাতে উঠে এল সুগন্ধী একটি খাম, কোনায় মেয়েলি ছাঁদের অক্ষরে লেখা সরোজিনী আর মাঝখানে অতি যত্নে জ্যোতির নাম। কাদম্বরীর বুক ধড়ফড় করে। ধোপানিকে বিদায় করে দিয়ে চিঠিটা খোলেন তিনি,–
প্রিয়তমেষু,
তোমার কাছ থেকে যে আনন্দ ও মর্যাদা পাইয়াছি, তাহা আমার বহুস্বপ্নের ফসল। কিন্তু যে কথা মুখে বলতে পারি নাই তাহা জানাইবার জন্যেই এই পত্র। দুপুরের দুষ্টামির পরে তুমি যখন আমার বালিশে মাথা রাখিয়া পরম আরামে ঘুমাইতেছ, তখন তোমার পাশে বসিয়াই তোমাকে লিখিতেছি। গোপন কথাটি হইল, আমার শরীরের মধ্যে তোমার একটি ক্ষুদ্র বীজ বাড়িয়া উঠিতেছে, কয়েকদিন বমিবমি লাগিতেছিল, এমাসে ঋতুদর্শন হয় নাই। প্রথমবার পোয়াতি হইবার সময়ে যেমন হইত ঠিক সেইরকম। তুমি শুনিয়া খুশি হইবে কি না জানি না বলিয়াই মুখে বলিতে পারি নাই। সন্তানের পিতৃপরিচয় আমি কাহাকেও জানাইব না, শুধু আমি জানিলাম আর তুমি। সংসার জানিবে ও আমার সন্তান, আমার একার। কোনও মূল্যেই আমি তোমাকে হারাইতে চাহি না। আমার শতশত চুম্বন গ্রহণ করিয়ো।
ইতি
তোমার একান্ত সরোজিনী।
বজ্রাহতের মতো বসে পড়েন কাদম্বরী। শব্দগুলি তার মাথায় বোঁ বোঁ করে ঘুরতে থাকে– দুপুরের দুষ্টামি, ক্ষুদ্র বীজ, সন্তানের পিতৃপরিচয়, চিঠি হাতে নিয়ে অজ্ঞান হয়ে মেঝেতে পড়ে যান তিনি। অনেক পরে রূপা এসে তার জ্ঞান ফেরায়।
থমথমে প্রতিমার মতো চিঠি হাতে নিয়ে দুদিন বসে রইলেন কাদম্বরী। জ্যোতি সত্যিই তাঁকে ঠকিয়ে বিনোদিনীর কাছে যান! জ্যোতির সন্তান এসেছে। বিনোদিনীর গর্ভে, তার মানে তার পৌরুষ নিষ্ফলা নয়! অর্থাৎ কাদম্বরীই বন্ধ্যা। সবাই যে তাঁকে বাঁজা বলে উপহাস করে সেটাই তবে সত্যি! হতাশায়, গ্লানিতে প্রতিমুহূর্তে তার মরে যেতে ইচ্ছে হচ্ছে, কিন্তু তার আগে জ্যোতির সঙ্গে একবার শেষ দেখা হবে না? উদবোধনের দিন পর্যন্ত অপেক্ষা করবেন তিনি, তারপর ভাবা যাবে কী করণীয়।