দেউড়িতে ঢং ঢং করে বেলা তিনটের ঘণ্টা পড়ে। এই ঘণ্টা বাজানোর প্রথাটিও ঠাকুরবাড়ির। এখন জোড়াসাঁকোয় লম্বা বারান্দা জুড়ে মেয়ে-বউরা বসবেন দাসীদের কাছে খোঁপা বাঁধতে। কাদম্বরীর খোঁপাদাসী সদর স্ট্রিটে এসেই তাঁর খোঁপা বেঁধে দেয় যত্ন করে। কোনওদিন মোচা খোঁপা তো কোনওদিন পৈঁচে ফঁস। হাতির দাঁতের বেলকুঁড়ি বসিয়ে কাদম্বরীর কবরী বেঁধেছে সে।
সাজগোজ হলে কাদম্বরী রূপাকে বলেন, চল বাড়ি থেকে পালিয়ে যাই। কত কী দেখার আছে পৃথিবীতে!
রূপা তো একপায়ে খাড়া, বলে চলে যাই। কিন্তু কোথায় যাবে? আমরা তো রাস্তাঘাট কিছুই চিনি না।
আচ্ছা, আমরা যদি মালিনীর সঙ্গে বইয়ের ঝোলা নিয়ে বাড়ি বাড়ি ঘুরি? কাদম্বরী বলেন, বেশ মজা হবে না?
তোমাকে দেখে কেউ বইওলি বলবে না, না হয় আটপৌরে শাড়ি পরলে, কিন্তু তোমার রূপ আর বনেদিয়ানা লুকোবে কী করে?
তা হলে চল গিরিশ ঘোষমশাইয়ের কাছে যাই, কাদম্বরী আর-একটি ভাবনায় উদ্দীপিত, বলব, আমাকে শিখিয়ে পড়িয়ে বিনোদিনীর চেয়ে ভাল অভিনেত্রী গড়ে নিন। আমি সেই মালিনীর গল্পের নায়িকার মতো মঞ্চে উঠে সবাইকে চমকে দেব।
আর নতুনদাদা প্রচণ্ড রেগে মঞ্চে উঠে তোমাকে মারতে যাবেন! রূপা হেসে কুটোপাটি হয়।
আর পুলিশ এসে ওঁকে বের করে দেবে– কাদম্বরীও হেসে গড়িয়ে যান। পরক্ষণেই সচকিত হয়ে বলেন, কিন্তু তারপর তিনি কোথায় যাবেন, সেই তো বিনোদিনী হতচ্ছাড়ির বুকে মুখ লুকোবেন! তা হলে এ প্ল্যান চলবে না। অন্য কিছু ভাবতে হবে, দাঁড়া।
রূপা উত্তেজিত হয়ে বলে, স্বদেশি দলে যোগ দেবে? যশোরের স্বদেশিদের কাছে চলে যাই চলো, দেশের কাজও হবে আর
আর হ্যারিসাহেবের সঙ্গে দেখাও হবে, কাদম্বরী ছদ্মরাগে রূপার চুলের ঝুটি নেড়ে দিয়ে বলেন, কী তাই তো? তোর যদি স্বদেশির নাম করে অভিসারে যাওয়ার এত শখ তো আমাকে টানছিস কেন?
আমি ওকে ছাড়া বাঁচব না নতুনবউঠান, রূপা চোখ ছলছল করে বলে ওঠে হঠাৎ। কিন্তু বাড়ির কেউ কি মেনে নেবে এই সম্পর্ক? তুমি আমাকে বাঁচাও।
কাদম্বরী সচকিত হন, রূপা, সেই তুই একটা গন্ডগোল বাঁধালি! আমি কাকে কী বলব, সে একটা চাল নেই চুলো নেই বাউন্ডুলে সাহেব, তার ওপর এখন আবার স্বদেশি করছে, পুলিশের খাতায় নাম উঠে গেছে হয়তো! তাকে বিয়ে করতে হলে তোকে বাড়ি থেকে পালাতেই হবে, কিন্তু খাবি কী, থাকবি কোথায়?
রূপা খিলখিল করে হেসে বলে, সেই যে কথায় আছে না, ভোজনং যত্রযত্র শয়নং হট্টমন্দিরে।
সে যে কী অপরূপ দৃশ্য হবে রূপা, কাদম্বরীও হেসে লুটিয়ে পড়েন, তুই আর তোর হ্যারিসাহেব হট্টমন্দিরে শুয়ে আছিস আর চারদিকে ভিড় করে লোকে এনকোর এনকোর বলে চিৎকার করছে, আহা!
যাঃ তুমি যে কী কথা বলছ নতুনবউঠান, রূপা লজ্জা পেয়ে ছুটে পালায়।
দরজার কাছে কারও পায়ের শব্দে চমকে উঠে কাদম্বরী দেখলেন রবি এসেছে। তার চোখ অভিমানে ছলছল করে ওঠে। চট করে মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে কাদম্বরী বললেন, বেঁচে আছি কিনা দেখতে এসেছ রবি?
রবি কাছে এসে নতুনবউঠানের থুতনি ধরে নিজের দিকে ঘুরিয়ে নেন, কাজলনয়ন থেকে গড়িয়ে পড়া অশ্রুটুকু পরমযত্নে মুছে দেন আঙুল দিয়ে। তারপর বলেন, রাগ কোরো না, প্রতিদিন তোমার জন্য আমার দুশ্চিন্তা হয়, প্রতিরাত তোমার কথা ভেবে ভেবে আমার ঘুম আসে না। কিন্তু আসতে পারিনি কিছুতেই।
তা পারবে কী করে? রবির হাত ঠেলে দিয়ে সরে যান কাদম্বরী। এখন তোমার নতুন বউয়ের সঙ্গে পুতুলখেলার সময়, এখন কি আর বুড়িবউঠানের সঙ্গ ভাল লাগে!
রবির মনে তীব্র আবেগের ধাক্কা লাগে, প্রতি পল-অনুপল যাকে মনে পড়ে, যার ছায়া থেকে সরার জন্য নিজের সঙ্গে যুদ্ধ করতে হয় পল-অনুপল, সেই মন প্রতিমা এ-কথা বলছেন!
রবি আর্তনাদ করে ওঠেন, যদি বুক চিরে তোমাকে দেখাতে পারতাম, নতুনবউঠান আমার ক্ষতবিক্ষত মন।
মিথ্যে বোলো না রবি, কাদম্বরী তাও অভিমান করেন, তুমিও তোমার নতুনদাদার মতো আমাকে মিথ্যে স্তোক দিচ্ছ। আমাকে কেউ আর ভালবাসে না। তার গায়ের কচি কলাপাতা রঙের জর্জেট শাড়িটি অবহেলায় মাটিতে লুটোয়।
বিদ্যুৎলতার ঈষৎ উন্মোচনে মাথা ঝিমঝিম করে ওঠে রবির, রেশমি জ্যাকেটের উদ্ধত নির্লজ্জতায় চোখ পুড়ে যায়। তিনি কাদম্বরীর কোমর জড়িয়ে হাঁটু গেড়ে মাটিতে বসে পড়ে বলেন, আমি ভালবাসি, আমি ভালবাসি। এরকম করে আর কাউকে কোনওদিন ভালবাসিনি নতুনবউঠান। যদি সাধ্য থাকত, তা হলে তোমার এই যন্ত্রণা দূর করতাম।
কাদম্বরীও শকুন্তলার মতো জড়িয়ে ধরেন প্রিয়তম হরিণশিশুটিকে, দুজনে দুজনকে তীব্র আবেগে জাপটে ধরে অনুচ্চারিত এক বেদনায় কাঁদতে থাকেন, কাঁদতেই থাকেন।
.
জ্যোতি বাড়িতে সময় দিতে পারছেন না। কাদম্বরীকে নিয়ে আবার জোড়াসাঁকোয় ফিরে গেলেন। সেখানে অন্তত কিছু লোকজন আছে, তাদের সঙ্গে ঝগড়া বিবাদে হাসি গল্পে দিন কেটে যাবে কাদম্বরীর, জ্যোতি কিছুটা নিশ্চিন্তমনে বিনোদিনীর কাছে কাটাতে পারবেন।
জাহাজ নিয়েও খুব ব্যস্ততা জ্যোতির। প্রচুর ঋণ নিয়ে জাহাজ সাজিয়েছেন। কামরা সৌন্দৰ্যায়নের ভার দিয়েছেন জ্ঞানদাকে। কাদম্বরীকেও এ-ভার দিতে পারতেন জ্যোতি কিন্তু আজকাল অপরাধবোধে তার সামনে দাঁড়াতেই ভয় পান। তা ছাড়া কাদম্বরীর রুচি চমৎকার হলেও জাহাজের কামরা সম্বন্ধে তাঁর কোনও ধারণাই নেই। জ্ঞানদা ফরাসি ইংরেজ অনেক জাহাজে চড়েছেন, তার অভিজ্ঞতার কারণেই জাহাজের সাজগোজ হয়েছে খুবই মনোহারী।