কে বলবে এহন তোমাকে দেইখ্যা! মৃণালিনী সাহস করে বলে ফেলেন, তোমারে দেইখ্যা মনে হয় যেন সাক্ষাৎ দশভুজা জগদ্ধাত্রী।
ও বাবা, মেয়ের মুখে দেখি বোল ফুটেছে! জ্ঞানদা আনন্দে হেসে ওঠেন। কিন্তু ওই যশুরে বুলি ছাড়তে হবে।
সন্ধেয় গানবাজনার আসর বসছে রোজই। জ্যোতির সঙ্গে অক্ষয় এসে হাজির হন প্রায়ই। পিয়ানোর রিডে দিশি-বিদেশি সুরের ওঠানামায় উত্তাল হয়ে ওঠে বির্জিতলাওর বাড়ি।
সে-সব উত্তেজনার অবসানের পর রাত হলে বালিকাবধুর পাশে শুয়ে রবির মনে পড়ে একাকিনী নতুনবউঠানের মুখ। কী করছেন তিনি? জ্যোতিদাদা কি বাড়ি ফিরেছেন? না ফেরার সম্ভাবনা খুব বেশি, তিনি এখন আবার বিনোদিনীর কাছে যাতায়াত করছেন। তা হলে একা সেই বিরহিণী কীভাবে রাত কাটাচ্ছেন। রবি উদ্বেগে বিছানা ছেড়ে উঠে পায়চারি শুরু করেন। বালিকা মৃণালিনী জানতে চায়, আপনার কী হয়েছে? ঘুম আসছে না? মাথা টিপে দেব?
তার মুখের দিকে তাকিয়ে রবির বড় মায়া হয়। বারো বছরের সরল বালিকা বোঝে না, তার পক্ষে চব্বিশ বছরের রবির জটিল মনোজগতে ঢোকা কত কঠিন।!
.
কাদম্বরী সত্যিই একা হয়ে পড়েছেন। রবি আসার সময় পায় না। জ্যোতি প্রায় রাতেই বাড়ি ফেরেন না। কোথায় থাকেন জানতে চাইলে বড় অশান্তি করেন, মনে মনে কাদম্বরীর গভীর সন্দেহ জ্যোতি নিশ্চয় বিনোদিনীর কাছে রাত কাটাচ্ছেন।
শুয়ে বসে তার দিন কাটে না, রাত কাটে না। খড়খড়ির ফাঁক দিয়ে রাস্তা দেখেন। রাস্তার ফিরিওলা, ঠেলাওলা দেখেন। সেলাই নিয়ে বসলেও মন লাগে না, মনের রং হারিয়ে গেছে যে! রূপাকে আনিয়ে নিয়েছেন সদর স্ট্রিটে, তার সঙ্গে বসে কখনও তাস খেলেন, কখনও চলে কাব্যপাঠ। আর প্রতিটি ছোটখাটো শব্দে চমকে উঠে দরজার দিকে তাকান, যেন মনে মনে কারও আগমনের প্রতীক্ষায় আছেন।
ওদিকে অলস দুপুরে বিনোদিনীর কোলে মাথা রেখে জ্যোতি গল্প করেন। জানো বিনোদ, নিলাম থেকে সস্তায় একটা জাহাজের খোল পেয়ে কিনে ফেলেছি। এবার জাহাজ সাজিয়ে গুজিয়ে তোমাকে নিয়ে অনেক দূরে পাড়ি দেব একদিন।
ওমা, বিনোদিনী জ্যোতির চুলে বিলি কেটে দিতে দিতে থেমে যান অবাক হয়ে, বলেন, জাহাজের খোল আবার কেনা যায় নাকি, ও দিয়ে তোমার কী হবে?
আরে বুঝতে পারছ না, জ্যোতি উৎসাহে উঠে বসেন, আস্ত জাহাজ কেনার চেয়ে খোল কিনে তাতে ইঞ্জিন জুড়ে কামরা লাগিয়ে নিলে কম খরচে চমৎকার জাহাজ হয়ে যাবে। আমি এবার জাহাজের ব্যাবসা করব, ইংরেজদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে। দেখো বিনোদ, আমার স্বদেশি জাহাজ লোকের নিশ্চয় পছন্দ হবে।
তুমি অতবড় জমিদারবাড়ির ছেলে, তুমি এ-সব জাহাজের ব্যাবসা ট্যাবসা করবে কেন? বিনোদিনীর বিস্ময় কাটে না।
জ্যোতি কিন্তু উৎসাহে টগবগ করছেন, জমিদার তো কী হয়েছে? আমার ঠাকুরদা দ্বারকানাথ তো টেগোর কোম্পানি খুলে ইন্ডিয়া জাহাজের মালিক হয়ে একসময় বিরাট ব্যাবসা করেছেন, তিনি ছিলেন প্রথম বাঙালি উদ্যোগপতি। বাঙালিরা কলম চালায় কিন্তু জাহাজ চালাতে পারবে না কেন? দেখে নিয়ো বিনোদ, আমার জাহাজ কোম্পানি অনেক বড় হবে, অনেক টাকা আসবে। আর সেই টাকা আমি থিয়েটারের জন্য খরচ করব।
বিনোদিনীকে গভীর আবেগে জড়িয়ে ধরে চুম্বন করে তিনি বললেন, আমি তোমার নামে থিয়েটার করে দেব বিনোদিনী সরোজিনী! তোমার কোনও সাধ অপূর্ণ রাখব না।
বিনোদিনীর ক্ষতে যেন প্রলেপ পড়ে, মনে খুব আনন্দ হয়। কৃতজ্ঞতায় ভালবাসায় জ্যোতির ইন্দ্রনিন্দিত শরীরে নিজেকে মিশিয়ে দেন বিনোদিনী। তৃষ্ণার্ত জ্যোতির দেহের প্রতিটি অঙ্গে বৃষ্টিফোঁটা হয়ে ঝরে পড়তে থাকেন। পরমসুখের সেই মুহূর্তে বিনোদিনীর স্বর্গীয় বিফলের মতো নিটোল স্তনে মুখ গুঁজে দেন জ্যোতি।
কিছুক্ষণ পরে স্তন থেকে নিজের অনিচ্ছুক মুখটিকে অল্প টেনে তুলে জ্যোতি বললেন, তুমি নিষিদ্ধ ফলের মতোই উত্তেজক।
কেন, তোমার ঘরে যে অনিন্দ্যসুন্দরী স্ত্রী আছেন শুনতে পাই ঠাকুর? তির্যক স্বরে বিনোদিনী জানতে চান, তার কাছে দেহসুখ পাওনি?
জ্যোতির মুখে ছায়া পড়ে। কাদম্বরীর কাছে তিনি অপরাধী। বিনোদিনীর তীব্র আকর্ষণে দিনের পর দিন, রাতের পর রাত, তাকে ঠকিয়ে চলেছেন। বিনোদিনী সেই নরম জায়গাটাতেই ঘা দিয়েছে।
কী গো সুপুরুষ, উত্তর দিলে না, বিনোদিনী নিজের বহুনন্দিত রতিক্ষমতার স্তুতি শোনার লোভে গলা জড়িয়ে ধরে আবার খোঁচান জ্যোতিকে।
জ্যোতি ধীরে ধীরে বিষাদমাখা গলায় বললেন, তিনি গৃহলক্ষ্মী। তার সঙ্গে রতিখেলায় তুলসীতলায় প্রদীপ জ্বালানোর আনন্দ, কিন্তু তুমি আমার উত্তেজক মদিরা। আমার সৃষ্টির উন্মাদনা। এই দুইয়ে তুলনা চলে না।
তার মানে? বিনোদিনী ছদ্ম রোষে বলেন, বলতে চাও, তিনি পবিত্র আর আমি সাতঘাটে ঘোরা অপবিত্র? তা হলে আর আমার কাছে আসা কেন?
বিনোদিনী ছিটকে সরে বসেন। জ্যোতি তার কাছে গিয়ে দুহাতের ঘেরে বেঁধে বলেন, অয়ি মানিনী, মানময়ী, তুমি সরে গেলে আমার লেখা বন্ধ হয়ে যাবে, গান থেমে যাবে। তুমি কি তাই চাও?
পৃথিবীর আদিম মানব মানবীর মতো উদ্দাম রতিখেলায় ডুবে গেলেন নাট্যকার ও মঞ্চসম্রাজ্ঞী।
.
কাদম্বরী তখন এ ঘর-ও ঘর ছটফট করছেন নিঃসঙ্গ যৌবনের ভারে। তার এই অতুল রূপরাশি আর কোনও পুরুষের মুগ্ধ দৃষ্টির প্রশংসা কুড়োয় না। পোষা। হরিণশিশুর মতো পায়ে পায়ে ঘোরে না কোনও রবি, কাব্যপাঠ করতে করতে মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে তার দিকে চেয়ে থাকেন না কোনও বিহারীলাল, কোনও অক্ষয় চৌধুরী তার চোখে চোখ রেখে গান গেয়ে ওঠেন না, তার আসঙ্গকামনায় থরথর করে ওঠেন না কোনও প্রেমাতুর স্বামী। কোনও শিশু তার স্তন্যসুধার জন্য মুখ বাড়ায় না। কী করবেন তিনি এই ভরাযৌবন নিয়ে?