বরং একটি দুঃসংবাদ এসে বাড়ির পরিবেশ আরও ম্রিয়মাণ করে তুলল। শিলাইদহে জমিদারির কাজ দেখতে গিয়েছিলেন বড় জামাই সারদাপ্রসাদ, হঠাৎ তার মৃত্যু হয়েছে। সৌদামিনী তখন কারোয়ারে, জ্যোতি তার পাঠালেন গুরুতর অসুস্থতার খবর দিয়ে। দুদিন পরেই তড়িঘড়ি সৌদামিনীকে নিয়ে শোকস্তব্ধ জোড়াসাঁকোয় পৌঁছলেন সত্যেন ও জ্ঞানদা।
শোকের মধ্য দিয়ে অচেনা শ্বশুরবাড়ির সঙ্গে বালিকাবধূর পরিচয় ঘটল। রবির নামের সঙ্গে মিলিয়ে এ বাড়িতে তার নতুন নাম রাখা হল মৃণালিনী।
১৮. তারকার আত্মহত্যা
রবির বিয়ের পরপরই ঠাকুরবাড়িতে অনেক ওলটপালট ঘটে গেল।
স্বামীর মৃত্যুতে সৌদামিনী সংসারে উদাসীন হয়ে পড়লেন। সেই সংবাদ পেয়ে মহর্ষি কিছুদিনের জন্য পাহাড় থেকে নেমে এলেন জোড়াসাঁকোয়।
নবদম্পতিকে চারটি মোহর দিয়ে আশীর্বাদ করলেন তিনি আর জমিদারি দেখার ভার দিলেন রবিকে। প্রতি সপ্তাহে অবশ্য রবিকে রিপোের্ট পাঠাতে হবে বাবামশায়ের কাছে। দিনকয়েক ইতস্তত গঙ্গায় নৌকোভ্রমণ করে দেবেন ঠাকুর শেষে চুঁচুড়ার একটি বাগানবাড়িতে আশ্রয় নিলেন।
মহর্ষি রবিকে চিঠি লিখে নির্দেশ দিয়েছেন, ইংরাজি শিক্ষার জন্য ছোটবৌকে লারেটো হৌসে পাঠাইয়া দিবে। ক্লাসে অন্যান্য ছাত্রীদের সহিত একত্র না পড়িয়া তাহার স্বতন্ত্র শিক্ষা দিবার বন্দোবস্ত উত্তম হইয়াছে। তাহার স্কুলে যাইবার কাপড় ও স্কুলের মাসিক বেতন ১৫ টাকা সরকারী হইতে খরচ পড়িবে।
ইতিমধ্যেই অবশ্য মৃণালিনীকে জোড়াসাঁকো থেকে নিজের বাড়িতে নিয়ে এসে তার পড়াশোনার ব্যবস্থা চালু করে ফেলেছেন জ্ঞানদা। লরেটো হাউসে মৃণালিনীকে আলাদা করে ক্লাস করানোর জন্য বেতন লাগছে সাত টাকা। রবির উপযুক্ত করে তোলার তাগিদে তাকে গান শেখানোর ক্লাসেও ভরতি করা হল।
তবে রবি এ-সবে একটু উদাসীন। নিজস্ব জীবনছন্দের মধ্যে হঠাৎ এসে পড়া এই বালিকাবধূকে নিয়ে কী করবেন তিনি ভেবে পাচ্ছিলেন না। এতদিন কখনও সদর স্ট্রিটে নতুনবউঠানের কাছে আবার কখনও মেজোবউঠানের কাছে বির্জিতলাওয়ে যে উদ্দীপক জীবনযাপনে অভ্যস্ত ছিলেন, তার বদলে জোড়াসাঁকোর নিস্তরঙ্গ দিনগুলো যেন কাটতে চায় না।
এখন জোড়াসাঁকোয় না আছে জ্যোতিদাদার প্রাণের আগুন, না আছে মেজোবউঠানের সুমার্জিত শিল্পসাহিত্যচর্চা, না নতুনবউঠানের মায়াবী উদ্ভাস। তেতলাঘরের নির্জনতায় তার প্রাণ হাঁফিয়ে ওঠে। মৃণালিনী কখনও এখানে থাকেন কখনও বা মেজোবউঠানের কাছে।
তার ওপর বন্ধুরাও যেন বর্জন করেছেন হানিমুনে ব্যাঘাত ঘটাবার ভয়ে। রবি বাধ্য হয়ে প্রিয়নাথকে চিঠিতে লিখলেন, Honeymoon কি কোনোকালে একেবারে শেষ হবার কোনো সম্ভাবনা আছে– তবে কি না, Moon-এর হ্রাসবৃদ্ধি পূর্ণিমা অমাবস্যা আছে বটে। অতএব আপনি Honeymoon-এর কোনো খাতির না রেখে হঠাৎ এসে উপস্থিত হবেন।
বউকে ছেড়ে সদর স্ট্রিট বা বির্জিতলাওয়ে আগের মতো পাড়ি জমাতেও পারছিলেন না রবি, এখন মেজোবউঠান মৃণালিনীকে নিয়ে গিয়ে যেন রবিকেও বাঁচিয়ে দিয়েছেন। রবি প্রায় সন্ধেবেলায় বির্জিতলাওর আসরে যোগ দিতে পারছেন। থেকেও যাচ্ছেন মাঝে মাঝেই। জ্ঞানদা মৃণালিনীর শিক্ষার জন্য এ-সব করছেন ঠিকই, কিন্তু তার হৃদয়ের গোপন একটি ইচ্ছেও এতে চরিতার্থ হচ্ছে, রবিকে কাদম্বরীর রাহুগ্রাস থেকে সরিয়ে আনতে পেরেছেন তিনি।
মৃণালিনীর পিঠছাপানো চুলে পরিপাটি করে খোঁপা বেঁধে দিতে দিতে জ্ঞানদা নিজের ফেলে আসা নববধূ-জীবনের গল্প বলেন, একবার আমাদের গুরুঠাকুর এসেছিলেন। তাকে বাবামশায় জিজ্ঞেস করেছিলেন কিরকম কন্যাদানে বেশি পুণ্য হয়। তিনি বললেন– সাতবছর বয়সে বিয়ে দিলে, অর্থাৎ গৌরীদানে। ঠিক সেই বয়সেই আমার বিয়ে হয়। কলকাতার ঠাকুরবাড়ি থেকে তখন যশোরে মেয়ে খুঁজতে পাঠাত, কারণ যশোরের মেয়েরা নাকি সুন্দরী হত। যেসব দাসীরা মনিবের পছন্দ ঠিক বুঝতে পারে, তাদের খেলনা দিয়ে তারা মেয়ে দেখতে পাঠাতেন। আমাদের ওখানেও এইরকম দাসী গিয়েছিল। দাসী পছন্দ করে গেলে যখন আমার বিয়ের দিন সব ঠিক হয়ে গেল, তখন বাবামশাই আমাকে আনার জন্য সরকার, দাসী, চাকর পালকি সব পাঠালেন।
বালিকা আস্তে করে বলে, আমাকেও তোদর বাড়ি থেইক্যা অনেক সুন্দর সুন্দর খেলনা আর শাড়ি গয়না পাঠিয়েছিল। গাঁয়ের লোকেরা কোনওদিন অমন দেখে নাই।
অ্যাই মেয়ে, এখানে ওরকম যশুরে বুলি বলবি না। শোন, আমার বিয়ে। তো তোদের মতো জোড়াসাঁকোর দালানে হয়নি, তখন শাশুড়ি বেঁচে ছিলেন। জ্ঞানদা স্মৃতিচারণ করতে থাকেন, বিয়ের পর বাসীবিয়েতে আমাকে মেয়েপুরুষ মিলে ঘেরাটোপ দেওয়া পালকিতে নিতে এসেছিল। শ্বশুরবাড়ির অন্দরমহলে যখন পালকি নামাল তখন বোধহয় আমার শাশুড়ী আমাকে কোলে করে তুলে নিয়ে গেলেন। তার ভারী মোটা শরীর ছিল, কিন্তু আমি খুব রোগা ও ছোট ছিলুম বলে কোলে করতে পেরেছিলেন। আমাকে নিয়ে পুতুলের মতো এক কোণে বসিয়ে রাখলেন। মাথায় এক গলা ঘোমটা, আর পায়ে গুজরী-পঞ্চম ইত্যাদি কত কি গয়না বিধছে। আমার পাশে একজন গুরুসম্পর্কীয়া বসে যৌতুকের টাকা কুড়োতে লাগলেন। আমি তো সমস্তক্ষণ কাঁদছিলুম।
জ্ঞানদা বলতে বলতে যেন অতীতে ডুবে গেছেন, আমার শ্বশুর যখন যৌতুক করতে এলেন তখন একটু জোরে ফুঁপিয়ে কেঁদেছিলুম। তিনি জিজ্ঞেস করলেন– কেন কাঁদছে? লোকে বললে– বাপের বাড়ি যাবার জন্যে। তাতে তিনি বললেন– বল পাঠিয়ে দেব। সকলে বলতে লাগলেন– দেখেছ কী সেয়ানা বউ! ঠিক তাকমাফিক চেঁচিয়ে কেঁদে উঠেছে, যখন শ্বশুর যৌতুক করতে এসেছে। কিছুদিন পর্যন্ত লোকে আমাকে রোজই দেখতে আসত ও নানারকম ফরমাশ করত– উপর বাগে চাও তো মা ইত্যাদি। মেয়েরা কাপড় পর্যন্ত খুলে দেখত। আমি খুব লাজুক ছিলাম। ঠিক তোমার মতো। সমবয়সিদের সঙ্গেও ভালভাবে কথা বলতে পারতাম না।